ভাসমান পেয়ারার হাট বলতে প্রথমেই আসে ঝালকাঠির ভিমরুলি হাটের কথা। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্রেতা, বিক্রেতা, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের পদচারণে জমে ওঠে ভাসমান পেয়ারার এই হাট। তবে ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে ছোট নৌকায় করে পেয়ারা-বাগানের ভেতর ঘুরে দেখা।

ছোট খালের ভেতর দিয়ে সরু অলিগলির পাড়ে পাড়ে পেয়ারা বাগানের সৌন্দর্য ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য নৌকায় ঘুরে বর্ণনা করেছেন স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ভিমরুলি বাজার মার্কেটের সভাপতি ভবেন্দ্রনাথ হালদার।

সরেজমিন বর্ণনা অনুযায়ী, পেয়ারা বাগানে প্রচুর কান্দি (মাটির সারি) আছে। দুটি কান্দির মধ্যে থাকা খালটিই হলো নালা। যাতে জলাবদ্ধ না হয়ে, জোয়ারের পানি ওঠানামা করতে পারে। পেয়ারার কান্দিতেই রয়েছে ভালো ফলনশীল আমড়া, যা দেখে যেকোনো পর্যটকই মুগ্ধ হন। কান্দিতে শিমের বিচি ও কলাগাছও লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া লেবু, বাতাবিলেবু, পেঁপে ও আম চাষের পাশাপাশি রবি শস্যও রোপণ করা হয় এই কান্দিতে।

তার কথার মাঝেই দেখা যায় নারী চাষিরাও নৌকা চালিয়ে বাগানের অলিগলিতে প্রবেশ করছেন। তারা বাগান থেকে পেয়ারা নৌকায় করে ভাসমান হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। সেখানে রোদ কিংবা বৃষ্টি, সব সময়ই ক্রেতার জন্য নৌকায় অপেক্ষা করে চাষি। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি হলেও উদাম গায়ে চাষিকে সইতে হয় আকাশের গর্জন।

পেয়ারার মৌসুমে ভিমরুলি ভাসমান হাটে ট্রলারযোগে দলে দলে আসতে থাকেন ভ্রমণপিপাসুরা। এক টুকরো প্রশান্তি এবং প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন নিতে সবাই আসেন এখানে। যেদিকে তাকাই, দিগন্তজুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। 

ভবেন্দ্রনাথ হালদার জানান, ২০০ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে এই এলাকায় পেয়ারার চাষ হচ্ছে। তার আগে তার বাবাও এই চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে এই বিশাল বাগানে তার ১৫ একর জায়গায় পেয়ারা, আমড়া, লেবু, বাতাবিলেবু, কলা ও আমসহ রবি শস্যের চাষ হচ্ছে। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে যে কটি এলাকায় পাকিস্তানি হানাদাররা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তৎকালীন হিন্দু অধ্যুষিত ঝালকাঠি তার একটি। তখন জীবন বাঁচাতে মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল এই বিশাল পেয়ারা বাগানে। পেয়ারা বাগানও বুক পেতে আশ্রয় দিয়েছিল শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের।

পেয়ারা বাগান ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খান সাইফুল্লাহ পনির বলেন, পেয়ারা বাগানে মানুষ শুধু আশ্রয়ই নেয়নি, ওখানে যুদ্ধ হয়েছে, অনেকে শহিদ হয়েছেন, মা-বোনেরা নির্যাতিত হয়েছেন। ওখানে অনেক যোদ্ধা ছিলেন, অনেকে ভারতে ট্রেনিং নিতে গিয়েছেন ওখান থেকে। রাজাকাররা ওই সময় রক্তের হলিখেলায় মেতে উঠেছিল। স্বর্ণালংকার লুট করে এই শহরে দেখাতে দেখাতে যেত।

এ প্রসঙ্গে ভবেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, ভিমরুলির এই আশুরিয়া বড় বাগানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। অন্য ছোট ছোট বাগান শত্রুরা কেটে ফেললেও এই বড় বাগানটি কাটার সাহস করেনি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ভিমরুলি, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, জগদীশপুর, আতা, জামুয়া, কাপুড়কাঠি, রামপুর ও মীরাকাঠিসহ আশপাশের এলাকার শত শত চাষি পেয়ারা বাগানের সঙ্গে জড়িত।

প্রসঙ্গত, সরকার-নির্ধারিত ঝালকাঠি জেলার দুটি ব্রান্ডিং পণ্যের একটি হলো পেয়ারা। 'পেয়ারা আর শীতলপাটি, এই নিয়ে ঝালকাঠি' এটি জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে ট্যাগ করা আছে। ট্যাগের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের লোগো করা হয়েছে পেয়ারা আর শীতলপাটির ছবি যুক্ত করে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনের ফোয়ারার মাঝখানে আকর্ষণীয়ভাবে র্মাণ করা হয়েছে শীতলপাটির ওপরে পেয়ারার ভাস্কর্য।

ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ভিমরুলি, মীরাকাঠি, ডুমুরিয়া, ভৈরমপুর, খেজুরা, খোদ্দবরাহর, বেশাইনখান, শংকরধবল, বেউখান, স্থানসিংহপুর ও কীর্ত্তিপাশা এই ১১টি গ্রামেসহ নবগ্রাম ইউনিয়নের নবগ্রাম, হিমানন্দকাঠি, দাড়িয়াপুর, সওরাকাঠি ও কঙ্গারামচন্দ্রপুর এই ৫টি গ্রাম এবং গাভারামচন্দ্রপুর, বিনয়কাঠি ও শেখেরহাট ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ২০টিরও বেশি গ্রামে পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। জেলায় এ বছর ৮০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। যার মধ্যে হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১০ হাজার কেজি।

পেয়ারাগাছে সাধারণত মাঘ-ফাল্গুন মাসে ফুল আসে। পরপর তিনবার ফুল আসে। আষাঢ় মাস থেকে পেয়ারা পাকা শুরু হয়। ভাদ্র মাস পর্যন্ত পেয়ারা পাওয়া যায়। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস পেয়ারার ভরা মৌসুম।

কলাপাতার ভাঁজে চার কোনা ঘর করে পেয়ারা যখন পাইকারি ক্রেতারা উঁচু করে সাজান, সে দৃশ্যটিও তাকিয়ে থাকার মতো। এ ছাড়া প্লাস্টিকের কেস ভরে বড় ট্রলারে পেয়ারা ওঠানো এ মৌসুমের নিয়মিত দৃশ্য। 

এ বছর পেয়ারাচাষিরা ভালো দাম পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী শুভ্রজিৎ হালদার। তিনি চায়ের দোকানদার হলেও একজন কৃষক এবং পেয়ারা, আমড়া ও লেবুর আড়তদার। তিনি জানান, গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে পর্যটক বেড়েছে। এই হাটে পর্যটকদের জন্য নৌকার ঘণ্টাপ্রতি ভাড়াও নির্ধারণ করা থাকে বলে জানান তিনি।

বরিশাল থেকে আসা এক তরুণ বলেন, ঝালকাঠির ভিমরুলির এই ভাসমান হাট অনেক সুন্দর। তার মতে চায়না ও ভিয়েতনামের মতো এটি এমন একটি হাট যেখানে সবুজের নিসর্গ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে নৌকা ভ্রমণ করে অনেক পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

আরেকজন বয়োজ্যেষ্ঠ দর্শনার্থী বলেন, শুক্রবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভিমরুলি ভাসমান বাজারে  ঘুরতে আসছি। এখানে আমড়া-বাগান আছে। মূলত পেয়ারা বাগানই সবাইকে অকৃষ্ট করে। এখানে সমস্যা হচ্ছে, থাকার ব্যবস্থা নাই, খাবারের মানও ভালো না। এগুলো উন্নত করা উচিত।

একজন কিশোরী জানায়, ভিমরুলি পেয়ারা-বাগান এসে আমাদের অনুভূতি অনেক মজার। আমরা সারাদিন অনেক আনন্দ করেছি ফ্যামিলির সঙ্গে ঘুরে। অনেক ভালো জায়গা। প্রতিবছরই এখানে আসি এবং আসতে চাই।

ভিমরুলি বাজার বেশ পুরোনো হলেও ৩০ বছর ধরে দারুণ জমে উঠেছে বলে জানান ভবেন্দ্রনাথ হালদার। তিনি আরও জানান, দক্ষিণাঞ্চলের এখন সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার ঝালকাঠি জেলার ভিমরুলি বাজার। এই বাজার দেখতে যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল ও ভারতের রাষ্ট্রদূতরা এসেছেন একাধিকবার। এ ছাড়া মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষও এখানে এসেছেন এবং আসছেন।

ঝালকাঠি পৌর প্যানেল মেয়র তরুণ কুমার কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারতীয় হাইকমিশনারসহ সাবেক রাষ্ট্রদূত হর্ষ বর্ধন স্রিংলা ও রীভা গাঙ্গুলি এই ভিমরুলি এসেছিলেন। তখন তাদের কাছে ভিমরুলির উন্নয়নের জন্য আহ্বান করেছিলাম। এ ছাড়া পর্যটন দিবসে পর্যটনমন্ত্রী, সচিব ও বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে জুম মিটিংয়ে ভিমরুলির উন্নয়নের দাবিদাওয়া করি। ভিমরুলির প্রতি যে মানুষের আবেগ, সেটিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে পর্যটন এলাকায় উন্নয়ন করতে চাই।

ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, জেলায় ৮০০ হেক্টর জমিতে এ বছর পেয়ারার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ও নবগ্রাম এই দুই ইউনিয়নের ১৬টি গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গাভারামচন্দ্রপুর, বিনয়কাঠি ও শেখেরহাট ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে মোট ৫৩০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়েছে।

ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলা ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার পাশাপাশি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলারও ১৫টি গ্রামে পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবেকুন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিমরুলির চাষিরা অনেক সময় আশানুরূপ দাম পান না। কারণ, ফলটা খুব দ্রুত বিক্রি করতে হয়। হিমাগারেও সংরক্ষণ করা সম্ভব না। চাষিদের নিয়ে পেয়ারার জ্যাম জেলি কীভাবে বানানো যায়, উপজেলা প্রশাসনের সে রকম পরিকল্পনা আছে। তবে করোনার কারণে এগোতে পারিনি।

ব্র্যান্ডিং পণ্য পেয়ারার বিষয়ে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিমরুলি ভাসমান বাজারের পাশে পর্যটকদের জন্য ওয়াচ ব্লক, সিটিং জোন, গোসলের জায়গা এবং নদীতে ঘাটলা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ট্যুরিজম বোর্ড ও এলজিইডির অর্থায়নে। ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন করে দেওয়া হয়েছে আইসিটি অধিদপ্তরের মাধ্যমে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও কিছু কাজের প্রস্তাব ছিল, যা করোনার কারণে সম্ভব হয়নি। বিশেষত হোটেল মোটেল করা যায় কি না সেদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এনএ