ভূমিহীনদের জমি দিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক
পঞ্চগড়ের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়া। সারাদেশের মতো এ জেলায়ও ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য সরকারি খাসজমির ওপর ঘর নির্মাণ প্রকল্প চলমান। তবে ব্যক্তিমালিকানা জমি অসহায়দের দান করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক (৭২)। তার দেওয়া ৯০ শতক জমিতে তৈরি করা হচ্ছে ৩২ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য নতুন ঘর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্রের সাহার তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হচ্ছে এসব ঘর। প্রতি ঘর ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে এবং এসব ঘর চলতি বছরের ১৬ মার্চের মধ্যে ৩২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করা হবে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
৮ জানুয়ারি সরেজমিন দেখা যায়, তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের রনচন্ডী গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধার জমিতে নির্মিত হচ্ছে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য এসব ঘর। সারি সারি এসব ঘর তৈরি দ্রুত শেষ করতে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ ইটের গাঁথুনি দিচ্ছেন, কেউ বালু-সিমেন্ট মিশ্রণ করছেন। আর এই কাজ তদারকি করে নিজেই আনন্দ উপভোগ করছেন আবদুল মালেক।
জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক উপজেলার রনচন্ডী এলাকার মৃত হোসেন আলীর ছেলে। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশকে হানাদারমুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য ১৮ বছর বয়সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণায় সারাদেশে প্রায় ৯ লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ঘর। দেশের বিভিন্ন জেলার মতো পঞ্চগড়েও ১০৭৭ পরিবার পাচ্ছে সরকারি নতুন ঘর।
এর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় ১৪২টি পরিবারের জন্য ২ শতাংশ খাসজমির ওপর দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি আধাপাকা ঘরসহ সংযুক্ত টয়লেট ও রান্নাঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে উপজেলার রনচন্ডী এলাকায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সরকারি খাসজমিতে নয়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে ৩২টি পরিবারের জন্য নতুন ঘর ও ঠিকানা। আর এই গুচ্ছ গ্রাম বা আশ্রম প্রকল্পের নামকরণ করা হচ্ছে ‘মালেকনগর গুচ্ছ গ্রাম’ নামে।
শুধু তা-ই নয় আবদুল মালেক এই পরিবারের জন্য ৯০ শতক জমি ছাড়াও যাতায়াতের জন্য আরও ১৫ শতক জমি সড়ক তৈরির জন্য দান করেছেন। এখানে যারা বসবাস করবেন, সেই পরিবারদের জন্য একটি বড় পুকুরও খনন করে দিচ্ছেন তিনি।
তা ছাড়া এসব পরিবারের জন্য রাস্তা নির্মাণসহ প্রতি ৩টি পরিবারের জন্য আলাদাভাবে টিউবওয়েল স্থাপন ও বৈদ্যুতিক লাইনের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, ৭২ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এর আগেও তার বাড়ির পাশে ৭০ শতক জমির ওপর ১৬টি গরিব অসহায় মানুষের বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দিনের যেকোন সময় এসে ঘরগুলো দেখেন এবং ঘুরে বেড়ান। তার ঘরে তিন স্ত্রীর ১৩ জন ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে ৪ ছেলে ও ৯ মেয়ে। ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তবে তার এমন কাজে তার প্রতিবেশীরাও আনন্দিত।
কয়েক দিন আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধান ও উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মাহামুদুর রহমান ডাবলু এই নতুন ঘর নির্মাণকাজের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যেই ঘরের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এবং পুরোদমে কাজ চলছে।
এ বিষয়ে কথা হয় সহিদুল ইসলাম ও আব্দুল আলিম নামের দুজন ভূমিহীন ও গৃহহীনের সঙ্গে। তারা জানান, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের জমি নাই, ঘরও নাই। আবদুল মালেক ও সরকার আমাদের থাকার জন্য নতুন ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে, এতে আমরা অনেক খুশি এবং আবদুল মালেক ও সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।
এদিকে স্থানীয়রা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেকের এমন কাজকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলছেন, আব্দুল মালেকের এমন মানবিক সহযোগিতা একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। তাই আমিও আমার বাড়ির পাশে ঘর নির্মাণের জন্য ৯০ শতক ও রাস্তা নির্মাণের জন্য আরও ১৫ শতক জমি দান করে দিয়েছি, যেন এসব গরিব অসহায় মানুষ বসবাস করতে পারে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক
এ বিষয়ে আবদুল মালেকের ছেলে আবদুর রহমান বলেন, আমার বাবা যে ৩২টি গরিব অসহায় পরিবারের ঘর নির্মাণের জন্য জমি দান করেছেন, এতে আমরা তার সন্তান হিসেবে গর্ববোধ করি। তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন আর আজ তিনি মানুষের বসবাসের জন্য নিজের জমি দান করলেন। আমার বাবার সঙ্গে একমত হয়ে আমরাও প্রতিদিন দেখতে আসি নির্মাণ হতে যাওয়া গুচ্ছগ্রাম। তবে সরকার যদি সব সময় এসব গরিব ও অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করে, তাহলে তাদের কষ্টটা অনেকখানি মোচন হবে।
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কাজী আনিছুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঘর নির্মাণের উদ্যোগে আমরা ধন্যবাদ জানাই। তবে এই উদ্যোগে বাস্তবতায় ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক। তিনি আন্তরিক হয়ে জমি দান করেছেন এবং তার জমিতে ঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি আমি চেয়ারম্যান হিসেবে যতটুকু পারি এখানে বসবাস যারা করবেন, তাদের পাশে থাকার এবং তাদের সহযোগিতা করব।
ঢাকা পোস্টকে আবদুল মালেক বলেন, আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। তাই আমিও আমার বাড়ির পাশে ঘর নির্মাণের জন্য ৯০ শতক ও রাস্তা নির্মাণের জন্য আরও ১৫ শতক জমি দান করে দিয়েছি, যেন এসব গরিব অসহায় মানুষ বসবাস করতে পারে। এর আগেও আমি ১৬টি ভূমিহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণের জন্য জমি দিয়েছি। অনেক ভালো লাগছে প্রধানমন্ত্রী আমার দান করা জমিতে গরিব মানুষের জন্য ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারস্বরূপ আমরা তেঁতুলিয়ায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য ১৪২টি ঘর বরাদ্দ পেয়েছি। তার মধ্যে রনচন্ডী প্রান্তে ৩২টি ঘর নির্মাণের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক তার ৯০ শতক জমি দান করেছেন। পাশাপাশি রাস্তার জন্যও তিনিও জমি দিয়েছেন। আমরা চেষ্টা করছি কাজের মানটা সর্বোচ্চ সঠিক রাখতে, যাতে ভূমিহীন ও গৃহহীনরা প্রধানমন্ত্রীর উপহার সঠিকভাবে বুঝে পান।
এ ছাড়া ঘর নির্মাণের বাইরে প্রতি তিনটি পরিবারের জন্য একটি করে টিউবওয়েল ও বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগসহ রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, যেন তাদের দুর্ভোগে পড়তে না হয়, জানান ইউএনও।
এনএ