ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্র, দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার একটি এমপিওভুক্ত মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। বুধবার (০৮ সেপ্টেম্বর) তিনি স্থানীয় একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে করোনার টিকা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি বেঁচে নেই। মারা গেছেন অনেক আগেই।
একই উপজেলার মোছা. গোলাপজান বিবি। বয়স ৮২ বছর। বয়স্ক ভাতার জন্য অনেক দিন ঘুরেছেন জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হয়। বৃহস্পতিবার (০৯ সেপ্টেম্বর) বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জমা দেওয়ার পর জানতে পারেন, তিনিও বেঁচে নেই।
বিজ্ঞাপন
শুধু মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও মোছা. গোলাপজান বিবি নয়, রাজবাড়ীর শত শত জাতীয় পরিচয়পত্রে রয়েছে এমন অসংখ্য ভুল। কেউ জীবিত থেকেও মৃত, কারও নামে ভুল, আবার কারও কারও বাবা-মার সঙ্গে রয়েছে বয়সের বিস্তর ব্যবধান। এসব ভুলে প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা থেকে। আবার অনেকেই উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও জাতীয় পরিচয়পত্রের সামান্য ভুলে সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে পোহাচ্ছেন নানা দুর্ভোগ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য নির্বাচন অফিস কার্যালয়ে গেলে কর্মকর্তাদের অসহযোগিতায় দিনের পর দিন ঘুরেও তারা সংশোধন করতে পারছেন না। নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, সঠিক কাগজপত্র না থাকায় সংশোধনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকেই।
বালিয়াকান্দি উপজেলার বাসিন্দা মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছি। দৈনন্দিন কাজে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি বিভিন্ন অফিসে ব্যবহার করেছি। টিকার আবেদন করাতে গিয়ে আমার তথ্য না আসায় নির্বাচন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আমি অনেক আগেই মারা গেছি ( জাতীয় পরিচয়পত্রে সার্ভারে আমাকে মৃত দেখাচ্ছে)।
একই উপজেলার গোলাপজান বিবি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বয়স্ক ভাতার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে মেম্বারসহ চেয়ারম্যানের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। অবশেষে চেয়ারম্যান বয়স্কভাতার জন্য অনলাইনে আবেদন করতে বলেন। আবেদন করার সময় কম্পিউটারে আমার কোনো তথ্য আসছিল না। পরে চেয়ারম্যানকে বিষয়টি বললে তিনি উপজেলা নির্বাচনে অফিসে গিয়ে জানতে পারেন, অনেক দিন আগেই আমি মারা গেছি। নির্বাচন অফিসের সার্ভারে আমাকে মৃত দেখাচ্ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলার বাসিন্দা বদিউজ্জামান টোকন বলেন, নামের ভুল রয়েছে। সংশোধনের জন্য পাঁচ বছর ধরে উপজেলা নির্বাচন অফিসের দ্বারে ঘুরছি। কিন্ত কোনো কাজে আসছে না।
একই উপজেলার আবুল বাসার বলেন, ছোট বোনের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য দুই বছর ধরে নির্বাচন অফিসে ঘুরছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজে আসছে না। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের আচরণে মনে হয় এ ভুল সংশোধন হবে না। তাই সংশোধনের আশা ছেড়েই দিয়েছি।
পাংশা উপজেলার কলিমহর ইউনিয়নের হামিদ মিয়া বলেন, আমি কাজের সূত্রে দেশের বাইরে থাকি। করোনার আগে দেশে আসছিলাম। আমার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ও মায়ের নাম ভুল ছিল। আমি সেটা সংশোধন করার জন্য জেলা নির্বাচন অফিসে গেলে তারা পাত্তাই দিতে চায় না। আজ আসেন, কাল আসেন বলতে বলতে বছর পার হয়ে গেছে। এখনও আমি আমার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে পারিনি।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সালাম মাস্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মায়ের চেয়ে ছেলে ২৫ বছরের বড়, বাবার চেয়ে ছেলে ৪ বছরের ছোট। এমন অভিযোগ শত শত জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রতিনিয়ত পাই।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকার কারণে অনেক অসহায় মানুষ সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার পরও সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা মুন্সি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র সব জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে সেই ব্যক্তি সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
রাজবাড়ী জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকতে পারে এবং তা সংশোধনও করা যায়। বেঁচে থাকতেও জাতীয় পরিচয়পত্রে মৃত এমন কয়েকটি পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও আমাদের কাছে যারা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য আসে তা দ্রুত সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি যেগুলো এখানে সংশোধন করা না যায় সেগুলো ঢাকায় পাঠিয়ে সংশোধন করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে অনেকেই সঠিক কাগজপত্র না আনায় তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন হয় না। সেক্ষেত্রে তারা নানা অভিযোগ তোলেন। তবে যদি এ ধরনের সম্যসা কারো যদি থেকে থাকে তাহলে সঠিক কাগজপত্র নিয়ে এলে অবশ্যই তাদের সমস্যা সমাধান করা হবে।
জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি ইতোমধ্যে আমার কানে এসেছে। আমি জানার সঙ্গে সঙ্গে স্ব স্ব উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করা হবে বলে জানান তিনি।
মীর সামসুজ্জামান/এসপি