বাদল মিয়া (৪৫) পেশায় দিনমজুর। লাভের আশায় এনজিও থেকে ঋণ ও সুদের ওপর টাকা নিয়ে অনলাইনভিত্তিক ই-কর্মাস ই-অরেঞ্জে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন। পরে অর্ডার করা ডিসকভার মোটরসাইকেল পেতে ৬৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি।

কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও বাদল মিয়া ই-অরেঞ্জ থেকে মোটরসাইকেল বা আসল টাকাও ফেরত পাননি। এতে সর্বস্বান্ত হয়ে দিশেহারা বাদল মিয়া ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন।

শুধু বাদল মিয়া নয়, টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাদিঘী গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পরিবার ই-অরেঞ্জসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণায় সর্বস্বান্ত। ওই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করেছেন কয়েক কোটি টাকা।

সরেজমিনে উপজেলার ইছাদিঘী গ্রামে কথা হয় কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে। এদের কেউ প্রবাস থেকে টাকা পাঠিয়েছেন, কেউ জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখেছেন, বিক্রি করেছেন বাড়ির গবাদিপশু, কেউ স্বর্ণ বিক্রি করেছেন আবার কেউ ঋণ বা সুদে টাকা নিয়ে দ্বিগুণ লাভের আশায় ই-কমার্সগুলোতে টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

এদিকে গ্রামের এসব নারী অনলাইন কেনাকাটা সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও অন্যদের মাধ্যমে লোভে পড়ে টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া দিনমজুর ও ভ্যানচালকসহ গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মানুষজনও ই-কমার্সগুলোতে টাকা পাঠিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

জানা গেছে, দেশে বেশ কিছু অনলাইন ভিত্তিক ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, আলিশা মার্ট, শ্রেষ্ঠসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

ই-অরেঞ্জসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণায় গ্রাহকদের মধ্যে অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স নিয়ে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পন্থায় প্রতারণা করছে।

এদিকে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের মামলায় ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আরেক মালিক শেখ মো. সোহেল রানাকে পুলিশ গ্রেফতার করায় টাকা পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন গ্রাহকরা।

ইছাদিঘী গ্রামের জমির হোসেন পেশায় একজন ভ্যানচালক। অনলাইন থেকে গ্রামের বিভিন্ন মানুষের উপার্জন দেখে তিনিও লাভের আশায় একটি এনজিও থেকে ১ লাখ টাকা উত্তোলন করে ই-কর্মাস কিউকমে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছেন গেল ৪ মাস আগে।

নিয়ম অনুযায়ী অর্ডার করে টাকা পাঠানোর পর ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেবে প্রতিষ্ঠান কিউকম। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মোটরসাইকেল পাননি তিনি।

জমির হোসেন বলেন, গ্রামের বহু মানুষ অনলাইন থেকে টাকা উপার্জন করে দেখে আমিও ঋণ করে একটা গ্রামের অন্যজনের মাধ্যমে কিউকমে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোটরসাইকেল পায়নি।

এদিকে ঋণ উত্তোলন করায় প্রতিনিয়তই এনজিও’র কর্মীরা ঋণ পরিশোধের জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। ভ্যান চালিয়ে যা উপার্জন তাতে সংসার চালানোই কঠিন। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে বলে জানান তিনি।

ওই গ্রামের প্রবাসীর স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, গ্রামের সবাই অনলাইনে টাকা পাঠিয়ে দ্বিগুণ টাকা পেয়েছে শুনে আমিও একজনের 
অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে স্বামীর পাঠানো ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ই-কর্মাস আলিশা মাটে মোটরসাইকেল অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছি ৪ মাস হল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোটরসাইকেল পাচ্ছি না।

ইছাদিঘী গ্রামের আরেক প্রবাসী হাসান আলীর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার বলেন, প্রবাস থেকে স্বামীর পাঠানো টাকা এবং ঋণ করে প্রায় ৬ লাখ টাকা দিয়ে ই-অরেঞ্জে কয়েকটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলাম। শুনেছি টাকা দিলে লাভ দেয়। মোটরসাইকেল চাইলে মোটরসাইকেল দেয়, না হলে টাকা দেয়।

তিনি আরও বলেন, লাভের আশায় ঢাকায় ভাগনের মাধ্যমে তার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ই-অরেঞ্জে মোটরসাইকেল অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছি গত এপ্রিল মাসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত টাকা ফেরত বা মোটরসাইকেল পাইনি। এদিকে আবার শুনেছি ই-অরেঞ্জের মালিকদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাহলে আমার টাকার কী হবে?

এ সময় কথা হয় শেফালি বেগম নামের আরেক ই-অরেঞ্জের গ্রাহকের সাথে। তিনি বলেন, লোভে পড়ে স্বামীকে না জানিয়ে বাড়ির জমি বন্ধক রেখে ও স্বর্ণ বিক্রি করে ই-অরেঞ্জে প্রায় ১০ লাখ টাকা টাকা পাঠিয়েছি। এর মধ্যে স্বামীও প্রবাস থেকে টাকা পাঠিয়েছিল। সে টাকাও ই-অরেঞ্জে দিয়েছি। শুনেছি দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু এখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি।

ইছাদিঘী বাজারের ব্যবসায়ী নাশিদুল ইসলাম বলেন, প্রথমবারে ই-অরেঞ্জে ৫টি মোটরসাইকেল অর্ডার করে সেগুলো পেয়েছিলাম। এতে ভালোই লাভ হয়েছিল। এর পর বেশি লাভের আশায় ঋণ ও সুদের ওপর টাকা নিয়ে পুনরায় ২০ লাখ টাকায় কয়েকটি মোটরসাইকেল অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাইনি।

ইতোমধ্যে শুনেছি ই-অরেঞ্জের মালিকরা গ্রেফতার হয়েছেন। এখন মালিকরা গ্রেফতার হলে বা তাদের সাজা দিয়ে যদি আমাদের আসল টাকাও সরকার ফেরত দেয় তাও দিক। তা না হলে সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসতে হবে বলে জানান তিনি।

উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাদিঘী গ্রামের মহিলা ইউপি সদস্য শেফালী বেগম বলেন, আমি নিজেই লোভে পড়ে প্রায় ৩ লাখ টাকা ই-অরেঞ্জে পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পণ্য পাইনি।

শুধু ইছাদিঘী গ্রামের দুই শতাধিক মানুষের কয়েক কোটি টাকা ই-অরেঞ্জে পড়ে রয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অনলাইন সম্পর্কে ধারণা নেই। এর পরও তারা লাভের আশায় ই-অরেঞ্জ টাকা পাঠিয়ে এখন সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।

এমএসআর