বাল্যবিবাহের শিকার এক স্কুলেরই ৫০ ছাত্রী
করোনাকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। এ সুযোগে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে অনেক কিশোরী। এ থেকে উত্তরণে তাই বিয়েকেই একমাত্র নিরাপদ মনে করছেন উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। কিন্তু বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে প্রশাসন এখন আগের চেয়ে সিদ্ধহস্ত। তাই প্রশাসনকে ফাঁকি দিতে অভিভাবকরা বেছে নিয়েছেন ভিন্ন ও অবৈধ পন্থা নোটারি পাবলিক। শুধু গরিব শ্রেণি নয়, ধনী পরিবারগুলোও ঝুঁকে পড়েছে বাল্যবিবাহের দিকে।
তবে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হওয়াকে আইনসম্মত বলছে না মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। তারা বলছে, বাল্যবিবাহের খবর পেলেই তার বিয়ের আয়োজন বন্ধ করছে, মুচলেকা নিয়ে বিয়েতে দেওয়া হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু কিছু বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারলেও অধিকাংশের খবর পাচ্ছেন না এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
বিজ্ঞাপন
এদিকে শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, স্কুল খুললেই কত ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে।
হঠাৎ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম অফিসার ফাতেমা জোহরা জানান, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেড়েছে। এ ছাড়া অনেক তরুণী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। তখন পরিবারটি ভেবে নিচ্ছে, বিয়েই একমাত্র বাঁচার পথ। তা ছাড়া লেখাপড়ার চাপ না থাকায় গরিব অভিভাবকরা মেয়েকে বোঝা মনে করছেন। আর ধনী পরিবার বাল্যবিবাহের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ হলো স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা।
তিনি বলেন, অধিকাংশ বাল্যবিবাহ হওয়ার পর অথবা কখনো কখনো দেড় থেকে দুই মাস পর আমরা খবর পাচ্ছি। তখন তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয়ে পরিবারটির কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হচ্ছে যে বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কিশোরীকে শ্বশুরবাড়িতে না পাঠানো ও ছেলের সঙ্গে একত্রে বসবাস করতে না দেওয়া।
কীভাবে হচ্ছে বাল্যবিবাহের আয়োজন
এ বিষয়ে ফাতেমা জোহরা বলেন, বর্তমানে অভিভাবকরা বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করছেন নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে। নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তারা বিয়ে সম্পন্ন করে হুজুর ডেকে মোনাজাত করে মনে করছেন বিয়ে হয়ে গেছে। তবে এটি অবৈধ। নোটারি পাবলিকের বিয়ের কাগজটির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। ওই ছেলে যদি পরবর্তীতে বিয়ে অস্বীকার করে, তখন মেয়ের পরিবার আইনি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অসুবিধায় পড়বে।
নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে কাগজ তৈরি করে বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। পরিবারটি ঘোষণা দিচ্ছে, আকিকা অনুষ্ঠান বা মুসলমানি অনুষ্ঠান। কখনো কখনো আত্মীয়স্বজনকে ডেকে খাওয়াদাওয়া করে। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে ছলচাতুরী করে আয়োজন করা হচ্ছে বাল্যবিবাহের অনুষ্ঠান। তবে তথ্য পেলেই আমরা সেটির ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সাতক্ষীরা জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ হয়েছে ১৪৯টি। তবে অধিকাংশই খবর না পাওয়ায় বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
বাল্যবিবাহ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পদক্ষেপ কী
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম শফিউল আজম বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সভা করা হচ্ছে। দ্রুত তথ্য ও পদক্ষেপ নিতে জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কিশোর-কিশোরী ক্লাব করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে, বর্তমানে অনলাইন প্রচারণাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়নের ভিজিডি প্রোগ্রামের আওতায় যারা রয়েছেন, তাদের মাঝে খাদ্য বিতরণের সময়ও বিষয়টি নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মসজিদের ইমামদের নিয়েও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয় কী
সরকারের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন উপপরিচালক এ কে এম শফিউল আজম। তিনি বলেন, এলাকায় একটি বিয়ের আয়োজনের খবর সবার আগে পান সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। তবে তারা নিজেদের ভোটের স্বার্থে কোনো ব্যবস্থা নেন না। এই ভাবনা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সংবাদকর্মীদেরও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনমত গঠনে সংবাদের মাধ্যমে সহায়তা করতে হবে। প্রশাসনসহ সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি বন্ধ করা সম্ভব। তা ছাড়া আদৌ সম্ভব হবে না।
সাতক্ষীরায় বাল্যবিবাহের শিকার কতজন
করোনাকালীন সাতক্ষীরা জেলাব্যাপী কতজন স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিশু-কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে গত এক বছর আট মাসে প্রতিরোধ করা গেছে ১৪৯টি বাল্যবিবাহের আয়োজন। যাদের কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। তবে মুচলেকা নেওয়ার পর তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেটির বিষয়ে কোনো তথ্য নেই জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার দপ্তরে।
তবে তারা জানিয়েছেন, বিয়ে বন্ধ করার পর বিষয়টি নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময়ে ফলোআপ করে থাকি। মুচলেকা অমান্য করায় ২০১৯ সালে দুই অভিভাবকের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় দুটি নিয়মিত মামলা করা হয়েছিল। যে মামলা দুটি আদালতে এখনো চলমান রয়েছে। স্কুল খুলে দেওয়ার পর অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির কতজন ছাত্রী স্কুলে অনুপস্থিত ও তাদের অবস্থান বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর জেলার বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে।
এক স্কুলেরই বাল্যবিবাহের শিকার ৫০ ছাত্রী
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৬৬ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ জনই বাল্যবিবাহের শিকার বলে জানিয়েছেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ। তিনি জানান, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল খলছে। তবে স্কুলের আঙিনায় আগের মতো কোলাহল আর হবে না। কারণ বাল্যবিবাহের শিকার ৫০ জনের মধ্যে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ৩২ জন। তাদের মধ্যে দশম শ্রেণির ১৪ জন, নবম শ্রেণির ৭ জন, অষ্টম শ্রেণির ১১ জন। বাকি ১৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। স্কুলের নথিপত্রে এসব মেয়ের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর।
মুচলেকা নিয়ে বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা, পরবর্তী অবস্থা
গেল ২ আগস্ট অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেন তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের ভৈরবনগর গ্রামের কৃষক মাতব্বর শেখ। তার মেয়ে ইউনিয়নের শার্শা দাখিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। বিষয়টি তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের দৃষ্টিতে এলে ওই দিনই বাল্যবিয়ের আয়োজনটি ভেঙে দেওয়া হয়।
মেয়ের বাবা মাতব্বর শেখ ও মা ফাতেমা বেগম, চাচা আকবর শেখের কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়। মুচলেকায় উল্লেখ করা হয়, জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী মেয়েটির জন্মতারিখ ০১.১০.২০০৪। ওই বিয়েতে ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নজমুন নাহার। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারির কয়েক দিন পর ওই বিয়ের আয়োজনটি সম্পন্ন হয়েছে। মেয়েটি এখন তার শ্বশুরবাড়িতে।
কী বলছে মেয়ের পরিবার
তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের ভৈরবনগর গ্রামের কৃষক মাতব্বর শেখ বলেন, আমরা গরিব মানুষ। মেয়ের বয়স হয়েছে। এখন বিয়ে দিতে না পারলে পরবর্তীতে ছেলেরা আর পছন্দ করবে না। এ ছাড়া এখন স্কুল-কলেজ বন্ধ। বাড়িতে বসিয়ে রেখে কী করব? এখনকার যুগের মেয়েদের বিষয়ে বোঝেন তো। মেয়েকে কিছুদিন বাড়িতে রাখলে আর বিয়ে হতো না। ওই দিন বিয়ে হয়নি। তবে পরবর্তীতে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এখন শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ কী
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তারিফ-উল-হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এমন খবর পাওয়ামাত্রই মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিয়েটি বন্ধ করা হয়। জেল-জরিমানার আওতায়ও আনা হচ্ছে আয়োজনকারী পরিবারকে। বর্তমানে করোনাকালীন বাল্যবিবাহের আয়োজন বেড়েছে। তবে প্রশাসনও তৎপর রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ্ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলীপুর মাধ্যমিক আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে, এমন তথ্য পেয়েছি। তবে অধিকাংশ স্কুলের কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ যে কমিটি রয়েছে, তারা কোনো কাজ করে না। বাল্যবিবাহের কোনো খবর পেলেই শিক্ষকদের বাধা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে বাল্যবিবাহের খবর আমরা পেয়েছি বা পাচ্ছি। তবে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য নেই জেলায় কতজন ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। তবে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল খুলে দেওয়ার পর একটা তথ্য আমরা জানাতে পারব। তবে ধারণা করা যায়, প্রতিটি স্কুলের কমবেশি ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
এনএ