ভেবেছিলাম চাকরি করব। বিধবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাব। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পর কোথাও চাকরি পাইনি। অনেক জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি, কোথাও চাকরি হয়নি। কেউ চাকরি দিতে চায় না। তাই এখন পানের দোকান করছি। কথাগুলো বলছিলেন ৩৫ বছর বয়সী হারুন উর রশিদ। সোমববার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে রংপুর প্রেস ক্লাবের সামনে লাঠিতে ভর করে তাকে আসতে দেখা যায়। 

দুই হাতে লম্বা দুটি লাঠি। এক-দুই কদম পা ফেলতেও হারুনের লাঠিই ভরসা। লাঠির ওপর ভর করে চলাফেরা। যেন লাঠির ওপর ভর করেই জীবন চলছে শারীরিক প্রতিবন্ধী এই যুবকের। 

রংপুর নগরের আট নম্বর ওয়ার্ডের সাহেবগঞ্জ এলাকায় হারুনের বাড়ি। তার বাবা আবদুল আউয়াল বেঁচে নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু বিধবা মা আনোয়ারা বেগম। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পড়ে ভালো থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করছে প্রতিবন্ধী হারুন। উদ্দেশ্য মায়ের মুখে একটু হাসি ফোটানো।

জন্মগতভাবে দুই পা বাঁকা হওয়ায় অন্য সবার মতো স্বাভাবিক চলাফেরা একদমই করতে পারেন না হারুন। তাই লাঠির ওপরেই ভরসা। দুই হাতে লাঠিতে ভর করে এক স্থান থেকে আরেক প্রান্তে চলাফেরা করতে হয় তাকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর বিভিন্ন সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যর্থতা তাকে দমাতে পারেনি। 

নগরীর প্রেস ক্লাবের পাশে নির্মাণাধীন সমবায় ভবনের কাছে ছোট্ট একটা পানের দোকান সাজিয়ে বসেছে হারুন উর রশিদ। দোকানে একটা উঁচু টুলের (পিড়ি) ওপর বসে পান সিগারেট বিক্রিতে ব্যস্ত হারুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জীবনে অনেক কষ্ট। শত কষ্টের মাঝেও আমি সামর্থ্য অনুযায়ী পড়ালেখা করেছি। ২০০৪ সালে হারাগাছ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে (জিপিএ ৩.৮০) এবং হারাগাছ মডেল কলেজ থেকে ২০০৬ এইচএসসি (জিপিএ ৩.৪০) পাস করি। খুব ইচ্ছে ছিল একটা চাকরি করব। মায়ের মুখে হাসি ফোটাব। কিন্তু কোথাও চাকরি পাইনি।

প্রতিবন্ধী এই অদম্য যুবক বলেন, আমার নিজের পড়াশুনার জন্য টিউশনি (প্রাইভেট) করেছি। মাস শেষে টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতাম। এইচএসসি পাসের পরও অন্যদের প্রাইভেট পড়িয়েছি। কোথাও চাকরি না পেয়ে অনেক কষ্ট হয়েছে। হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু যখন বুঝেছি প্রতিবন্ধীদের কেউ সহজে চাকরি পায় না, তখন থেকে আশা ছেড়ে দিয়েছি।

 চাকরি না পেয়ে জীবনের তাগিদে বিক্রি করছেন পান

সংসারের উন্নতি করার জন্য ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নেন হারুন। সেই টাকায় ৭০০ মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে তার খামারটি বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেক লোকসান গুণতে হয়েছে।

হারুন আরও জানান, তার বাবার দেওয়া ছয় শতাংশ জমি ছাড়া তার আর কিছু নেই। সেই জমির ওপর মুরগির খামারের ঘর আছে। কিন্তু মুরগি নেই। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তাকে খামারি থেকে পান দোকানদার বানিয়েছে।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় কোথাও কোনো কাজের সন্ধান মেলেনি দাবি করেন হারুন রশিদ। ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রতিবন্ধী। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারিনা। লাঠিছাড়া চলাফেরা আমার জন্য অসম্ভব। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ছোটবেলা থেকেই শরীরের সব শক্তি দিয়ে দুই হাতে লাঠির ওপর ভর করে ঘোরাফেরা করে আসছি। বেঁচে থাকার জন্য নিজের জীবনের সঙ্গে আমি যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমি কারো কাছে ভিক্ষা চাই না। সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে একটা সহযোগিতা চাই। আমি চাই নিজের মেধা, শক্তি আর সামর্থ্য দিয়ে কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। একটা ভালো কিছু করতে। 

কোথাও কাজের সুযোগ না পেয়ে মাস চারেক আগে ধারদেনা করে রংপুর নগরের প্রেস ক্লাব মোড়ে সমবায় ব্যাংকের পাশে পানের দোকান দেন হারুন রশিদ। ছোট্ট একখানা পানের দোকানের আয় দিয়ে সংসার চলে তার। হারুন বর্তমানে তার বিধবা মাকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন।

চোখে মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে প্রতিবন্ধী হারুন বলেন, রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। সরকারি চাকরিতে সুযোগ হয়নি। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাতেও চেষ্টা করেছি। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। 

কখনও প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি সহায়তা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা বা ভাতা পাইনি বলে জানান হারুন উর রশিদ। ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন সংসার চালাতে কষ্ট হলেও মা সঙ্গে থাকায় আমার চিন্তা নেই। মায়ের মুখ দেখে সকালে বের হয়ে আসি আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে দেখি। এটাই প্রশান্তি। আমরা ছয় ভাই, তিন বোন। বিয়ের পর থেকে সবাই সবার মতো আলাদা থাকে। কেউ কৃষি কাজ, কেউ মানুষের দোকানে কাজ করে। শুধু আমার বিয়ে হয়নি।

প্রতি মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা ৭৫০ টাকা পান। সঙ্গে পানের দোকান থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন। হারুন বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল দাদা পানের দোকান করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৫-৬টা পর্যন্ত যা বিক্রি হয়, তাতে কোনো রকমে দিন যায়‌। এই পরিস্থিতিতে আমি কারো কাছে হাত পাততে চাই না। আমি সমাজের পরোপকারী মানুষদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা চাই। যাতে জীবনে ভালো কিছু করতে পারি।

সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মামুনার রশিদ মানিক মাস্টার বলেন, আমি হারুনের খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করি। এখন তো সরকারিভাবে ভাতা পাচ্ছেন হারুন। তবে তার জন্য আরও কিছু করার চিন্তা রয়েছে। যাতে সে স্থায়ীভাবে কিছু করতে পারেন।

এসপি