চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ যেন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পাথর নিক্ষেপ বন্ধে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিলেও কোনো কাজে আসছে না। এদিকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে ট্রেনযাত্রীরা নানা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। কেউ হারাচ্ছেন চোখ, কেউ পঙ্গু হচ্ছেন সারা জীবনের জন্য। অনেক সময় যাত্রীদের প্রাণ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে পাথরের আঘাতে।

এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীরা ট্রেনে চলাচল করছে আতঙ্ক নিয়ে। তাই জানালা বন্ধ রাখছেন পুরোটা সময়। তবে পাথর নিক্ষেপের প্রায় ৭০টি স্পট চিহ্নিত করেছে বলে জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

পাথর নিক্ষেপ থামাতে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, রেললাইন ঘেঁষে মাইকিং, স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসছে না।

রেল কর্মচারী ও যাত্রীসাধারণের দাবি, অপরাধী যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক। ব্যাপক গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং এলাকাটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এমনটিই প্রত্যাশা সবার।

এ ছাড়া লোকাল ও মেইল ট্রেনের জানালায় গ্লাস কিংবা অ্যালুমিনিয়ামের শাটার নেই বললেই চলে। আন্তঃনগর, মেইল কিংবা লোকাল সব ট্রেনে শুধু পাথর নিক্ষেপ নয়, টানপার্টি, অজ্ঞান পার্টি, ছিনতাইকারীদের জন্যও ট্রেনের জানালা এখন আতঙ্ক। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের মতো বর্বরকাণ্ডে শুধু সাধারণ যাত্রীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে না, ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনও ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

তেমনই এক দুর্ঘটনা ঘটে ২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে। ঢাকাগামী আন্তঃনগর কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব পৌর শহরের লক্ষ্মীপুর লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় এলোপাতাড়ি পাথর নিক্ষেপ শুরু হয়। এ সময় জানালার কাচ ভেঙে সহকারী চালক কাউসার আহমেদের দুচোখ রক্তাক্ত জখম হয়। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার দুটি চোখই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পরে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে জিআরপি পুলিশ সন্দেহভাজন ১৫ শিশু-কিশোরকে আটক করলেও শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেয়।

কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সহকারী চালক কাউসার আহমেদ

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেলপথের ভৈরব উপজেলার লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের লেভেল ক্রসিং এলাকা এখন রেলকর্মী ও যাত্রীদের মরণফাঁদে পরিণত করেছে। সীমিত পর্যায়ে রেল চলাচলের মধ্যেও পাথর নিক্ষেপের অন্তত ২০ থেকে ২২টি ঘটনা ঘটেছ। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ট্রেনের কর্মচারীসহ ৪০ থেকে ৪৫ জন যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এ ছাড়া চুরি-ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হওয়ায় আতঙ্কে থাকেন এ লাইনের ট্রেন কর্মচারী ও যাত্রীসাধারণ। বৃহস্পতিবার এমন এক পাথর নিক্ষেপের ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সহকারী চালকের দুটি চোখ নষ্ট হতে বসেছে। এমন ঘটনার পরও স্টেশনমাস্টার এমনকি জিআরপি পুলিশ সহজে মুখ খুলতে চায়নি।

তবে শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) সব মসজিদ থেকে পাথর নিক্ষেপ থেকে শিশু-কিশোরদের নিবৃত রাখতে এবং সচেতন করতে মসজিদে মসজিদে মাইকিং করানোর হয়েছে বলে দাবি ওই এলাকার ওয়ার্ড কসউন্সিলরের।

একসময় যে রেলপথ ছিল সব শ্রেণির মানুষের নিরাপদ যোগাযোগমাধ্যম। আজ সে মাধ্যমটিতে পাথর নিক্ষেপ এবং চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে রেল কর্মচারী ও যাত্রীসাধারণকে। সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি প্রভাবের কারণে কার্যকর ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে।

রেল কর্মচারী ও যাত্রীসাধারণের দাবি, অপরাধী যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক। ব্যাপক গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং এলাকাটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এমনটিই প্রত্যাশা সবার।

জানা গেছে, ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারা অনুযায়ী চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের শাস্তি যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড। পাথরে রেলযাত্রীর মৃত্যু হলে ৩০২ ধারায় ফাঁসির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের অপরাধে অভিভাবকের শাস্তির বিধানও রয়েছে।

লক্ষ্মীপুর এলাকার আউটার সিগন্যাল এলাকার বৃদ্ধ আবুল কাশেম মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সহকারী চালকের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। এমন ঘটনা যে কারও সঙ্গে ঘটতে পারে। তাই আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

আমানে খাতুন নামের এক নারী যাত্রী বলেন, আমি নিয়মিত রেল পথের যাত্রী। এখন তো আতঙ্কে থাকি কখন জানালা দিয়ে পাথর এসে শরীরে পড়ে। আবার কখন ছিনতাইকারী এসে ব্যাগ, মোবাইল ও অলংকার টান দিয়ে নিয়ে নেয়।

আহত কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সহকারী চালক কাউসার আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেনটি লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় কে বা কারা ইঞ্জিন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারলে ইঞ্জিনের গ্লাস ভেঙে যায়। এ সময় ভাঙা গ্লাসের টুকরা এসে আমার চোখের ভেতরে ঢুকে যায়। এতে আমার চোখে মারাত্মক আঘাত লাগে। তখন আমি কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিলাম না।

ট্রেনের পরিচালক আবু সায়িদ বলেন, ভৈরব স্টেশনে প্রবেশের আগে লক্ষ্মীপুর এলাকার আউটার সিগন্যাল পার হওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা পাথর ছোড়ে। সহকারী চালক কাউসার আহমেদ মারাত্মক আহত হন। তাকে ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করা হবে।

ভৈরব বাজার স্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার জহুরুন্নেছা বলেন, এ ঘটনা শুধু গত বৃহস্পতিবার না। এই লাইনে এমন ঘটনা অতীতে অনেক ঘটেছে। এ ঘটনাগুলোর কোনো সমাধান হয়নি। এ জন্য আমরা আতঙ্কিত। এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে এ সেবায় বিঘ্ন ঘটবে।

ভৈরব ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিন্টু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাটি শোনার পরই আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত সহকারী চলকের খোঁজখবর নিয়েছি। শুক্রবার আমি আমার এলাকার প্রতিটি মসজিদের মাইকের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। যাতে আর এমন ঘটনা না ঘটে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রচারণা চালালে আমি তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করব।

ভৈরব রেলওয়ে থারার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফেরদৌউস আহমেদ জানান, এই ব্যাপারে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এনএ