করোনায় কাজ হারিয়েছে অবকাশ যাপন কেন্দ্রের ২০ হাজার কর্মী
ইট-পাথরের চার দেয়ালে বন্দি জীবন থেকে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ কত কিছুই না করে। ছুটে যান সমুদ্রের কাছে, পাহাড়ের কাছে; দেশ থেকে বিদেশে। তবে রাজধানী ঢাকা থেকে মানুষের স্বল্প সময়ে অবকাশের অন্যতম স্থান গাজীপুর। শাল-গজারি বন, গ্রামীণ পরিবেশে প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা দিতে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবকাশ কেন্দ্র।
কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনায় এক বছরের বেশি সময় বন্ধ রয়েছে অবকাশ যাপন কেন্দ্র। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পর্যটন খাত। কবে নাগাদ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে এসব কেন্দ্র তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নিবন্ধিত ৭৬টিসহ আরও শতাধিক ছোট-বড় রিসোর্ট রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে এসব রিসোর্টে জনসামগম নিষিদ্ধ করেছিল জেলা প্রশাসন।
অবকাশ কেন্দ্র বন্ধ থাকায় ঘোর অন্ধকার তৈরি হয়েছে উদ্যোক্তাদের মধ্যে। পাশাপাশি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে অবকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও। ইতোমধ্যে অনেকের চাকরি চলে গেছে, বেতন-ভাতাও বন্ধ হয়ে গেছে অনেকেরই।
ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে, গাজীপুরের অবকাশ কেন্দ্রগুলোতে কাজ করত প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক। করোনায় চাকরি হারিয়েছে ২০ হাজার শ্রমিক। বেতন-ভাতাও বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের।
জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নে ৭০ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ড্রীম স্কয়ার রিসোর্ট। প্রতি মাসে ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকার বেশি। এক বছর ধরে কোটি টাকার ওপর লোকশান গুনতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. নুরে আলম সিদ্দিকী বাবু জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে ১৩০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। করোনায় কাউকে চাকরিচ্যুত না করলেও বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি আমাদের এই পর্যটন খাত। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এখন বিধিনিষেধ উঠে গেলেও নিয়মিত পর্যটক আসছে না। কত দিন এভাবে চলবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
একই উপজেলার পৌর এলাকার ভাংনাহাটি গ্রামে প্রায় পাঁচ একর জমিতে গড়ে উঠেছে সবুজ পাতা নামে একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র। গ্রামীণ পরিবেশের মধ্যে আধুনিক সকল সুবিধা ও নয়নাভিরাম এই অবকাশ কেন্দ্রটি কয়েক কোটি টাকা বিনোয়োগ করে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ২২টি কক্ষ। এই অবকাশ কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয় ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে। উদ্বোধনের কয়েক দিন পরই করোনার বিধিনিষেধের মধ্যেই এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর এক বছর পার হয়ে গেছে। প্রথম দিকে ২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছে মাত্র পাঁচজন। বিদ্যুৎ বিলসহ মাসে আনুষাঙ্গিক লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাইমুল হক খান জানান, অবকাশ কেন্দ্রটি উদ্বোধনের পরই করোনার বিধি-নিষেধের মধ্যে পড়ে। লোকসান গুনতে গুনতে অনেক কর্মচারীকে বাধ্য হয়ে ছুটি দিতে হয়েছে।
সদর উপজেলার শালবন গ্রিণ রিসোর্টের মহাব্যবস্থাপক মোল্লা আল-আমিন বলেন, করোনার কবলে পড়ে অধিকাংশ কর্মীদের ছাঁটাই করতে হয়েছে। বর্তমানে চারজন কর্মী নিয়ে কোনোমতে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
জেলা শহরের পাশেই সুকুন্দি এলাকায় ৫০ বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন রিসোর্ট ছুটি। ঢাকার পাশে অবস্থিত রিসোর্টটি সেবা ও অন্যান্য দিক থেকে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। মাসে অনন্ত ৫০-৬০ হাজার দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর থাকত ছুটি রিসোর্ট।
রিসোর্টের সিনিয়র মার্কেটিং অফিসার মো. তুহিন হোসেন জানান, ছুটি রিসোর্ট একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির প্রতিষ্ঠান। প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। করোনায় কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত না করে বেতন ও অন্যান্য ভাতা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এখন করোনা পরবর্তী ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মার্কেটিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, জেলাজুড়ে শতাধিক অবকাশ কেন্দ্র গড়ে উঠলেও জেলা প্রশাসন থেকে নিবন্ধন রয়েছে ৭৬টির। দীর্ঘ দিন ধরেই সরকারের সকল নিয়ম কানুন মেনে পরিচালিত হচ্ছে এসব অবকাশ কেন্দ্র।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, স্বাভাবিকভাবেই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত। দীর্ঘ দিন ধরে গাজীপুরের এসব অবকাশ কেন্দ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে অন্যতম ভূমিকা রেখে আসছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে। আশা করছি অন্ধকার ভেদ করে শিগগিরই আলোর মুখ দেখবে অবকাশ কেন্দ্রগুলো।
তিনি আরও বলেন, ৭৬টি অবকাশ কেন্দ্রের নিবন্ধন থাকলেও অনেকেরই আবার নিবন্ধন নেই। আমরা সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছি। নিবন্ধনের বাইরে থাকা রিসোর্টগুলোকে ইতোমধ্যেই চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনায় আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এরপরও এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমিয়ে রিসোর্টগুলোকে টিকে থাকার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সেইসঙ্গে ঘোষিত প্রণোদনা আরও সহজ শর্তে দিতে হবে।
এসপি