বরগুনা এলজিইডি কার্যালয়ে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না
ঘুষ-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বরগুনার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখানে কড়ায় গন্ডায় শতকরা হিসেব করে ঘুষ দিতে হয় ঠিকাদারদের। এতে যে কোনো উন্নয়ন কাজের গুণগত মান নিয়েও চরম সংশয় দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি এলজিইডি বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে প্রকাশ্যে ঘুষ-দুর্নীতির একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ।
বিজ্ঞাপন
এলজিইডি বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের একজন ফোরম্যান মো. জিয়াউর রহমানকে একটি ভিডিওতে প্রকাশ্যে বলতে শোনা গেছে ‘আগে ভাই মাল দিয়ে কথা বলেন’। ওই ভিডিওটিতে জিয়াউর রহমানকে গুনে গুনে ঘুষের টাকা গ্রহণের পাশাপাশি পুকুর ও খাল খনন (আইপিসিপি) প্রকল্পের অধীনে ওই দফতরের কোন কোন কর্মকর্তাকে কত পার্সেন্ট ঘুষ দিতে হয় তা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাছে বুঝিয়ে বলতে দেখা গেছে।
এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের আরও বলেন, প্রকল্প পরিচালক বাবদ ২২ হাজার টাকা, নির্বাহী প্রকৌশলীকে দুই পার্সেন্ট অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা এবং এসও নজরুল ইসলামের জন্যে তিনি ১৩ হাজার টাকা কেটে রেখেছেন। আর সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. হোসেন আলী মীর এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিনের জন্য নির্ধারিত টাকা তাদের হাতে হাতে দিয়ে আসতে বলেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বরগুনার আমতলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হিসাবরক্ষক মো. হুমায়ুন কবির অফিসকক্ষে ধুমপানরত অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘টাকা দিতে হবে, টাকা না দিলে কোনো বিল দেওয়া যাবে না। এ টাকা আমি একা খাই না। আপনারা টাকা কম দিলে আমি কি আমার পকেটের টাকা দিয়ে স্যারদের দেব।’
বরগুনা সদর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের একজন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমানের ঘুষ গ্রহণের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি নিজেই ঠিকাদারদের কাছ থেকে জোর করে ঘুষ আদায় করছেন। এর আগে ঘুষ লেনদেনকে ঘিরে দ্বন্দ্বের জের ধরে উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান এবং একজন সংক্ষুব্ধ ঠিকাদার মো. ফরহাদ জোমাদ্দারের বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে প্রকাশ্য মারামারি ও ধস্তাধস্তির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে।
ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, ধস্তাধস্তির সময় উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান এবং ঠিকাদার মো. ফরহাদ জোমাদ্দার একে অপরকে ‘সুদখোর’ এবং ‘খুষখোর’ বলে গালি দিয়ে কিল ঘুষি মারছেন এবং মাটিতে পড়েও তারা ধস্তাধস্তি করছেন। এ ঘটনার সংবাদও প্রকাশ হয় ঢাকা পোস্টে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) বরগুনার অধীনে আমতলী ও তালতলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ২০২০ সালের ২৮ জুলাই ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩টি লোহার সেতু সংস্কারের জন্যে দরপত্র আহ্বান করে এলজিইডি বরগুনা। ওই দরপত্র অনুয়ায়ী সেতু নেই এমন কোথাও নতুন করে সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই। অথচ দরপত্রে উল্লেখিত ৩৩টি সেতুর মধ্যে একটি সেতুর বাস্তবে কোনো সন্ধান মেলেনি। চারটি বাঁশের সাঁকোকে সেতু দেখিয়ে তা সংস্কারের জন্যে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় এলজিইডি।
এ ঘটনায় এলজিইডি বরগুনার অনিয়ম-দুর্নীতি ও ভৌতিক সেতু নিয়ে গত বছরের আগস্ট মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে ওই ভৌতিক দরপত্রটি বাতিল করতে বাধ্য হয় এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের অভিযোগ, বরগুনার এলজিইডি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী ঠিকাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ঠিকাদাররা বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ উন্নয়নকর্মী। আমরা সরকারের সকল প্রকার উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করে থাকি। এসব উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্ত্রী-জায়া-জননীর স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে তারপর রড-সিমেন্ট কিনি, মিস্ত্রির খরচ মেটাই। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে পকেটের টাকা খরচ করে সরকারের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করি। অথচ সেই কাজ বাস্তবায়নের পরে বিল তুলতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে আমাদের কড়ায় গন্ডায় ঘুষের পার্সেন্টেজ গুনতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ভুক্তভোগী ঠিকাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাজ পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়, ওয়ার্ক ওর্ডার পেতে ঘুষ দিতে হয়, কাজ বাস্তবায়নের সময় তদারকি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হয়, এরপর বিল পাওয়ার আগে হিসাবরক্ষকসহ অফিস সহকারী, উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী এমনকি প্রকল্প পরিচালকসহ ঘাটে ঘাটে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এসব কারণে ঠিকাদারি পেশা থেকে এখন সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) অধীনে গঠিত বরগুনা জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট অনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা কমিয়ে আনতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে টিআইবি। ঘুষ-দুর্নীতির এমন চিত্র কোনোভাবেই কাম্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন।
অনিসুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি- বরগুনার এলজিইডি অফিসের এসব অনিয়ম, দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অচিরেই যাতে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শিগগিরই আমরা এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি সভা করবেন। সেই সভায় এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
এ বিষয়ে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি ও বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সারাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অগ্রণী। এখানকার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৌরাত্মে শুধুমাত্র সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আমরা আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দেবেন।
এ বিষয়ে এলজিইডির বরগুনা কার্যালয়ের ফোরম্যান মো. জিয়াউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অসুস্থ, ফরিদপুরে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। আমি শিগগিরই অফিসে আসব এবং এসে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলব।
কবে অফিসে আসবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আসব শিগগিরই।
এ বিষয়ে জানতে বরগুনার আমতলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক মো. হুমায়ুন কবিরের ফোনে একাধিক বার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনি কোন ভিডিওর কথা বলছেন তা আমি অবগত নই। ভিডিওটি দেখালে আমি এ বিষয়ে বলতে পারব।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এজিইডি) বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী এসকে আরিফুল ইসলাম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না বলে জানান।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতির বিভিন্ন ভিডিওচিত্রের বিষয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তার দফতরের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী কী বক্তব্য দিয়েছেন তা তাদের নিজস্ব বিষয়। এসব বক্তব্যের দায়দায়িত্বও তাদের।
আরএআর