তীব্র ভাঙনের কবলে পদ্মার তীর
চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীতে আবার ভাঙন শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহে সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের গোয়ালডুবি গ্রামের প্রায় ২০০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন শুরুর পর নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। হুমকির মধ্যে রয়েছে চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাখের আলী, মোড়লপাড়া, ফাটাপাড়া, চাকপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙন দেখে এই গ্রামের বাড়ি-ঘর ভেঙে অনত্র নিয়ে যাওয়ায় ব্যস্ত গ্রামবাসী। কাটা হচ্ছে ছোট-বড় সব ধরনের গাছ। ইতোমধ্যেই পদ্মায় বিলীন হয়েছে এই গ্রামের পাকা-আধাপাকা কয়েকটি ঘরবাড়ি। স্থানীয়রা জানায়, হঠাৎ করে এক সপ্তাহ থেকে এই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়। কয়েকদিন বিরতি দিয়ে গত মঙ্গলবার পুরোদমে তাণ্ডব চলে গোয়ালডুবি গ্রামে।
বিজ্ঞাপন
ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর পাড়ে জিওব্যাগ ফেলা শুরু করেছে৷ তবে জিওব্যাগ নয়, বাঁধ নির্মাণ করাই স্থায়ী সমাধান বলছেন স্থানীয়রা। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ নির্মাণ করা গেলে এখনকার ভাঙন রোধ করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন তারা। ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
ফাটাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আকমল হোসেন নিজের উর্পাজনের সবটুকু দিয়ে ৪ মাস আগে নতুন করে বাড়ি বানিয়েছেন। পদ্মা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার ও নদী থেকে বাড়ির দূরত্ব ২৫০ মিটার হওয়ায় প্রায় ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেন।
আকমলের ভাই স্কুল শিক্ষক সৈয়বুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সাড়ে ৪ বিঘা জমি, আমবাগান, দুটি বাড়ি তলিয়ে গেছে। মাত্র ৪ মাসের পাকা বাড়িটি নিমিষেই হারিয়ে গেল পদ্মার মাঝে। বাড়ির ভেতরের মালপত্র নিয়ে সরে যাওয়ারও সময় পাইনি। ভাইয়ের বাড়ি ভাঙতে দেখে এখানকার প্রায় আরও ২০টি পরিবার ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
ভাঙনকবলিত এলাকা গোয়ালডুবির পাশের গ্রাম চাকপাড়ায় বাড়ি মুদি দোকানি মো. সাহিনের। তিনি জানান, এর আগেও এই এলাকায় এসেছি। কিন্তু গত মঙ্গলবার বিকেলে এসে দেখি ৪টি বাড়ি নাই। পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এখান থেকে অনেক দূরে, তারপরও তীব্র স্রোত সব ধ্বংস করে নিয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) নদীতে ভাঙন না থাকলে এর প্রভাব রয়েছে প্রবল। নদী পাড়ে লাগানো ছোট ছোট গাছ কাটা নিয়ে ব্যস্ত স্থানীয়রা। পঞ্চাশোর্ধ মো. ফজলুর রহমান বলেন, তাড়াহুড়ো করে গাছগুলো কেটে নিচ্ছি। গাছগুলো লাগানো এক বছরও হয়নি। কিন্তু কী করব, ভাঙনে তো সব হারিয়েছি। গাছগুলো কেটে যতটুকু খড়ি পাওয়া যায় তাই লাভ। চোখের সামনে বাড়িঘর, জমিজমা সব পদ্মায় হারিয়ে গেল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহফুজ হাসান ঢাকা পোস্টকে জানান, বাড়িগুলো থেকে আধা কিলোমিটার নদীর দূরত্ব ছিল। কিন্তু এতো দ্রুত গতিতে নদী ভাঙন হচ্ছে যে, বাড়িঘর ও বিভিন্ন আসবাবপত্র সরানোর সময় পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। থেমে থেমে হঠাৎ করে দিন-রাতের যেকোনো সময় ভাঙন শুরু হচ্ছে। বাঁধ তৈরি করা দেখেই ভরসা পেয়ে অনেকেই পাকাবাড়ি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।
চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. ইব্রাহিম আলী বলেন, নদী ভাঙন কবলিত এলাকার ৪টি গ্রামের বাসিন্দারা কঠিন সময় পার করছে। তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সর্বনাশা পদ্মা যেভাবে তার আগ্রাসী থাবা দিয়েছে তাতে জিও ব্যাগ দিয়ে রক্ষা করা অসম্ভব। কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন, এই এলাকার মানুষের জন্য খাদ্যসামগ্রী বিতরনের জন্য।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভারতের দুটি রাজ্য উত্তর প্রদেশ ও বিহারে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে সেখানে সবগুলো পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এর ফলে পদ্মা নদীতে অধিক স্রোতের কারণে ভাঙন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙনকবলিত ও হুমকিতে থাকা এলাকায় নদীর পাড়ে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান জানান, এই মুহূর্তে উত্তাল পদ্মা নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন কাজ। পাউবো কর্তৃপক্ষ নদী রক্ষায় সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের গোয়ালডুবি গ্রামে ভাঙনের খবর পাওয়ার সাথে সাথেই জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ শুরু করা হয়েছে।
এই গ্রামে হঠাৎ করে নদীর পাশ দিয়ে জায়গা নিয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে এবং তা অনেকদূর পর্যন্ত গেছে। সাধারণত নদী ভাঙনের এমন ধরন দেখা যায় না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষক দল সরেজমিনে কাজ করছে বলে জানান তিনি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি আব্দুল ওদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে পদ্মা নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। চলতি বছরে ব্লক নির্মাণের কাজ চলছে। আগামী বছর বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলে ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে এই এলাকার মানুষ। এছাড়াও নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলম/এমএসআর