চুইঝালের মাংস, শুনলেই যেন জিভে জল আসে। স্বাদে-ঘ্রাণে ও ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ জনপ্রিয় মসলা চুইঝাল। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এর রয়েছে নানা উপকারিতা। গরু, খাসি কিংবা হাঁসের মাংস— চুইঝাল ছাড়া যেন জমেই না। মাংসের সঙ্গে চুইঝালের মিশেলে তরকারির স্বাদ হয়ে ওঠে লোভনীয়। এ জন্য খুলনার চুকনগর, জিরোপয়েন্টসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট। আর দূরদূরান্ত থেকে খুলনায় কেউ এলে একবার হলেও রেসিপির স্বাদ গ্রহণে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। 

আর চাইবেই-বা না কেন? লোভনীয় চুইয়ের মাংস একবার খেলে যে বারবার খেতে ইচ্ছে হয়। এ ছাড়া চুইঝালের কাণ্ড, শিকড়, পাতা, ফুল, ফলে আছে ঔষধি গুণ। এর কাণ্ড বা লতা মাছ-মাংসের সঙ্গে রান্নার পর টুকরাগুলো চুষে বা চিবোলে বেরিয়ে আসে ভিন্ন এক স্বাদ। এটি শরীরের কোনো ক্ষতি করে না। তাই ঘরে ঘরে তরকারির সঙ্গে জনপ্রিয় মসলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই সপুষ্পক লতা।

২১ জুলাই (বুধবার) উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদে গরু ও খাসিসহ বিভিন্ন পশু কোরবানি করবেন সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা। তাই মাংস থাকবে সবার ঘরে ঘরে। ঠিক এই সময়ে চুইঝালের মাংস না খেলে কি চলে! তাই তো খুলনার বাজারগুলোতে বিক্রি বেড়েছে চুইঝালের। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে ঝাল-জাতীয় এই মসলার।

বিভাগের খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও নড়াইল এলাকায় এই চুইঝাল মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়। আবার খুলনা অঞ্চলের চুইঝালের কদর রয়েছে দেশজুড়ে। এ জন্য খুলনায় এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। চুইঝালের চারা সারাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। গাছটির চারা, কাণ্ড, লতা ও শিকড় বিক্রি করে জেলার অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক চুইঝালের মাংসের হোটেল-রেস্টুরেন্ট।

খুলনার জিরোপয়েন্টের কামরুলের হোটেলের বিক্রেতা শরীফ পোদ্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, হোটেলে মাছ, গরু ও খাসির মাংস বিক্রি হয়। চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংসের তরকারির জন্য হোটেলটি বিখ্যাত। এ মাংস খেতেই মানুষ এখানে বেশি আসে। হোটেলে রান্না করা দৈনিক ২ মণ মাংস বিক্রি করা হয়। এতে ১৫ থেকে ২০ কেজি চুইঝাল প্রয়োজন হয়। চুইঝালের মাংসকে কেন্দ্র করে প্রথমে কামরুলের হোটেল এবং পরবর্তীতে ৪০টির মতো হোটেল ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে বলে জানান শরীফ।

কামরুলের হোটেলে চুইঝালের গরুর মাংস খেতে আসা দৌলতপুরের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম সাগর বলেন, চুইঝাল মাংসের স্বাদ অতুলনীয় করে তোলে। আমি সময় পেলেই চুইঝালের মাংস খেতে জিরোপয়েন্ট, বেজেরডাঙ্গা, চুকনগরে ছুটে যাই। কখনো একা, কখনো বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে। চুই খুলনার একটি ঐতিহ্যবাহী মসলা। খুলনার চুইঝালের সুনাম দেশজুড়ে রয়েছে।

বাড়িতে চুইঝাল লাগিয়েছেন ডুমুরিয়ার রংপুর ইউনিয়নের ঘোনা মাদারডাঙ্গা এলাকার গৃহিণী টুম্পা মন্ডল। তিনি বলেন, বেশি পরিশ্রম করা লাগে না। একটু গোবর ও সার দিয়ে প্রথমে চারা লাগানো হয়েছে। বাড়িতে একটু বেশি গাছ হয়েছে বলে রান্নায় প্রতি তরকারিতে দেওয়া হয়। তাই বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে না। চুইঝাল খেতে খুব সুস্বাদু। এটি তরকারির স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।

খুলনা মহানগরীর হাউজিং বাজার এলাকার গৃহিণী উর্মি রহমান বলেন, চুইঝাল খুলনার ঐতিহ্যবাহী একটি মসলা। চুইঝাল বেশির ভাগই আমরা গরুর মাংসে ব্যবহার করে থাকি। সামনে ঈদ আসছে, গরুর মাংসে চুইঝাল দিলে তার স্বাদটা আরও বেড়ে যাবে।

নগরীর গল্লামারী বাজারের চুইঝাল বিক্রেতা মো. শাহিনুর মল্লিক জানান, বিভিন্ন প্রকারের ও দামের চুইঝাল রয়েছে। ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে তিনি ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে চুইঝাল বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, খুলনায় চুইঝালের চাহিদা অনেক। এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এটি গরুর মাংসের স্বাদ ও গন্ধকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয়।

কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক বলেন, আমি একসময় পরের ক্ষেতে জোন (শ্রমিক) দিতাম। এখন চুইঝালের চারা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছি। চুইঝাল একটি লাভজনক ফসল। এটি চাষ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছে।

কৃষক নিউটন মন্ডল বলেন, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় খুলনার চুইঝালের চারার ব্যাপক সাড়া পড়েছে। প্রতিটি চারা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি করি। ছায়াযুক্ত জায়গায় এই চারা লাগালেও হয়। এটি লাভজনক একটি ব্যবসা। ১০০ পিস গাছ লাগিয়ে ১০ হাজার টাকা খরচ করলে এক বছর পর এক-দেড় লাখ টাকা লাভ করা যায়।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোসাদ্দেক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চুই একটি ঝালজাতীয় মসলা। এটি খুব সহজেই চাষ করা যায়। এটি মূলত জমিতে, গাছের সঙ্গে, ছাদে ও পরিত্যক্ত জমিতেও চাষ করা যায়। বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর ও এপ্রিল-মে মাস এটি লাগানোর উপযুক্ত সময়। এই চারা একবার লাগালে বেশ কয়েক বছর চুই পাওয়া যায়। দুই-তিন কাঠা জমিতে চারা লাগানোর এক-দেড় বছর পর ২ থেকে ৩ লাখ টাকার চুইঝাল বিক্রি করা যায়। এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ফসল।

তিনি আরও বলেন, চুই একটি ঔষধি গুণসম্পন্ন মসলা। এটি স্বাদে-গুণে ভরপুর। এটি শুধু যে খাবারের স্বাদ বাড়ায় তা না, এটি নিয়মিত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। মাথাব্যথা, গায়ের ব্যথা, অ্যাজমার সমস্যা দূর হয়। বয়স্কদের গিঁটে ব্যথা দূর হয়।

চুইঝালের উপকারিতা
চুইঝাল খেতে ঝাল হলেও এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ। চুইলতার শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল-ফল সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। এতে রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল থাকে। চুইয়ের শিকড়ে রয়েছে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ পিপারিন। ক্যানসার, হৃদরোগ, শরীরব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, গ্যাস্ট্রিক, অ্যাজমা, অনিদ্রাসহ অসংখ্য রোগের প্রতিষেধক হিসেবে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে খুবই পরিচিত এই চুইঝাল।

চুইঝালের ব্যবহার ও রান্না
চুইঝাল মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রান্নার জন্যে চুইঝালের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এই কাণ্ড বা লতা কেটে টুকরা করে মাংস-মাছ রান্নায় ব্যবহার করা হয়। খুব ঝাল হলেও এর একটা অন্য রকম স্বাদ ও ঘ্রাণ আছে। ঝাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁস, খাসি ও গরুর মাংস রান্না করতে। মাংস ৬০ শতাংশ সেদ্ধ বা কষানো হয়ে গেলে তরকারিতে কাণ্ডগুলো ছোট ছোট টুকরা করে কেটে দিতে হবে। তাতেই চুইঝাল ভালোমতো সেদ্ধ হয়ে যায়। মাংস ছাড়াও বড় মাছ, খিচুড়ি, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের তরকারির সঙ্গে চুইঝাল মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এনএ