ঈদ করা হবে না ১২ হাজার কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকের
করোনাকালীন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বন্ধ নেই। বেসরকারি চাকরিজীবীরাও কমবেশি বেতন-বোনাস পাচ্ছেন। নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে আর্থিক প্রণোদনাও পেয়েছেন। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীদের খবর কেউ রাখেনি। তাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন ১২ হাজার শিক্ষক।
করোনায় কিশোরগঞ্জের ৭৯২টি কিন্ডারগার্টেনের ১২ হাজার ৩৭৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী প্রায় দেড় বছর ধরে বেতন-বোনাস পাচ্ছেন না। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে এক অনিশ্চিত জীবনযাপন অতিবাহিত করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
গত বছরের মতো এ বছরও এল দুটি ঈদ। রজমানের ঈদ চলে গেল। স্ত্রী-সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি। এবার এল কোরবানির ঈদ। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর সন্তানরা তাকিয়ে আছে, তাদের বাবা এবার অন্তত কিনে দেবে নতুন জামা। কিন্তু কীভাবে বোঝাবেন সন্তানদের, সেই কষ্ট বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এসব শিক্ষক।
এদিকে এই দেড় বছরের মধ্যে অনেকে পেশা বদল করেও টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খাচ্ছেন। এতে চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা। অন্যদিকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৭ হাজার ২৮৮ জন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতির প্রভাবে ড্রপ আউটের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ায় এবার অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে বলে জান গেছে।
জেলার ৭৯২টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১২ হাজার ৩৭৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত। প্লে-নার্সারি, কেজি এবং প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির টাকায় এসব স্কুলের ভাড়া, নানা ধরনের বিল এবং শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। এসব স্কুলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানরা পড়ালেখা করে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা টিউশন ফি দিতে পারছেন না। ফলে গত বছরের মার্চ মাস থেকে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের বেতন-বোনাস বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্ডারগার্টেনের এসব শিক্ষক স্কুল থেকেও খুব কম বেতন পেলেও তারা প্রাইভেট-টিউশনি করে সংষার চালাতেন। করোনাকালে তাও বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েন তারা। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা পেশা বদল করেছেন। কেউ সবজি বিক্রি করছেন, কেউ দোকানে কর্মচারীর কাজ নিয়েছেন। কিন্তু তারপরও জীবন চালাতে খাবি খাচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, সরকার দুই দফায় নন-এমপিওর ৮০ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষক ও ২৫ হাজার ৩৮ জন কর্মচারীকে সহায়তা দিয়েছে। দুই দফার প্রতিবার শিক্ষকরা এককালীন পাঁচ হাজার টাকা আর কর্মচারীরা আড়াই হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় এই টাকা অপ্রতুল হলেও কিছুটা সহায়ক হয়েছে। সম্প্রতি সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেখানে কিন্ডারগার্টেনের অন্তর্ভুক্তি নেই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি চাকরিবঞ্চিত উচ্চশিক্ষিত বেকার নারী-পুরুষরা নব্বইয়ের দশকে দেশব্যাপী কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে তুলেন। বাস্তবতার দিক বিবেচনা করে সরকার এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বিনা মূল্যের সরকারি বই সরবরাহ করে। সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে সরকার বিশেষ কেন্দ্রের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি পঞ্চম শ্রেণির সার্টিফিকেট প্রদানের ব্যবস্থা করে।
শিক্ষকদের পরিবারের স্বাভাবিক জীবযাপনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার সময়ে এসেছে বলে দাবি বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক ও ভুক্তভোগী শিক্ষকদের।
জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার মির্জাপুরের উদিতা কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক জুয়েল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার আগে টিউশন ফি দিয়ে সুন্দরভাবে স্কুলটি পরিচালনা করে আসছিলাম। অথচ গত বছরের মার্চ থেকে কাউকে আর বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়িওয়ালাকে কিছু টাকা দিয়ে এখনো স্কুলটি ধরে রেখেছি। এর মধ্যে অনেক টাকা দেনা হয়ে গেছে। এভাবে আর পারছি না!
তিনি আরও বলেন, স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া আমি এখন বাধ্য হয়ে পোলট্রি ব্যবসা শুরু করেছি। এবং আমার স্কুলের অনেক শিক্ষকও তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে কিন্তু তারপরও টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খাচ্ছি।
যশোদল ইউনিয়নের জননী কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক মো. আল আমিন জানান, পরিবারের অভাব ঘোচাতে তিনি বাড়ির পাশের একটি জমি ভাড়া নিয়ে টিনের স্থাপনা তৈরি করে জননী নামে কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে তোলেন। ১৬ জন নারী-পুরুষ শিক্ষক নিয়ে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। শিক্ষার্থী মিলে ১৫৩ জন। কিন্তু করোনার থাবায় সব শেষ হয়ে গেছে তার।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি শহরের ঐতিহ্যবাহী গার্ডেনিয়া কিন্ডারগার্টেনের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক কোহিনূর আফজল ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ১৯৯৭ সালের দিকে ওই এলাকায় একটি একতলা পাকা স্থাপনা ভাড়া নিয়ে গার্ডেনিয়া কিন্ডারগার্টেন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ২৩ জন উচ্চ শিক্ষিত নারী-পুরুষ শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু হলে সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বন্ধ ঘোষণার দিন পর্যন্ত এ স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল ২৭৫ জন।
তিনি জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর কোনো অভিভাবক আর টিউশন ফি দিচ্ছেন না। স্কুলটি টিকিয়ে রাখতে আমি স্কুলের জমির ভাড়া দিয়েছি। শিক্ষকরা ভীষণ কষ্টে আছেন। তাদের তো টাকাপয়সা দিতে পারছি না। অনেকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে টিকে থাকার কঠিন সংগ্রাম করছেন।
অনেকটা রাগ-ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কিছু বলার ভাষা নেই। আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি। করোনাকালে সরকার ১২ হাজার ৩৭৯ জন শিক্ষক-কর্মচারীর কথা একবারও ভাবল না! আমার অনুরোধ, যদি আমাদের ন্যূনতম অবদানও থাকে, তাহলে দ্রুত আমাদের প্রণোদনা দিন, বেঁচে থাকতে সহায়তা করুন। উদ্যোক্তাদের বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় এসব শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ভয়াবহ মানবিক বিপর্যের সম্মুখীন হবে।
এনএ