ঈদে চামড়া কেনার আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের
রংপুরে চামড়া কেনা-বেচার জন্য হাজীপাড়া চামড়াপট্টি বিখ্যাত। প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করেন এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতারা। তবে এ বছরের চিত্র ভিন্ন। চামড়া কেনার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের তেমন আগ্রহ নেই। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী গুদাম বন্ধ করে রেখেছেন। চামড়া কেনাবেচার এই এলাকাতে এখন সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে।
চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় হাতে গোনা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে পশুর চামড়া ন্যায্য দামে বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে আসন্ন ঈদ-উল-আজহার কোরবানির পশুর চামড়া কেনাকে সামনে রেখে চামড়াপট্টিতে তেমন কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই। প্রায় ১০-১২ জন ফড়িয়া এবং হাতেগোনা ৩-৪ জন ব্যবসায়ী চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, চামড়ার ব্যবসা না থাকায় এখন ঈদের দিন ছাড়া বোঝা যায় না এলাকাটির নাম চামড়াপট্টি। অথচ একসময়ে এই এলাকাতে শতাধিকের বেশি চামড়ার গুদাম ছিল। রংপুর ও ঢাকার বাইরের আড়তদারদের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি। এসব এখন ইতিহাস।
দিন দিন গুদাম বন্ধের সঙ্গে চামড়া বিমুখ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। আগের মতো চামড়া ব্যবসার রমরমা দিন না থাকায় এখন সমিতিও বিলুপ্ত প্রায়। চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন অটোবাইক ও রিকশার দোকান। এ কারণে চামড়াপট্টি এখন অটোপট্টিতে পরিণত হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন যারা বাপদাদার এই ব্যবসা ধরে আছেন, তারা হাতে গোনা কয়েকজন।
তাদের দাবি, এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারিভাবে চামড়া কেনাবেচায় নীতিমালা তৈরি, চামড়া শিল্পে ঋণের ব্যবস্থা করাসহ কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সরকারকে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যবসায়ী তফেল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে জানান, দেশ স্বাধীনের আগে এই চামড়াপট্টি গড়ে ওঠে। তখন এখান থেকেই নিয়মিত কলকাতায় যেত চামড়া। শুরুতে দেড় শতাধিকের বেশি ব্যবসায়ী চামড়া কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই সময় চামড়ার ব্যবসার এতই প্রসার ঘটে, লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা চামড়ার দুর্গন্ধে আশপাশের মানুষ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারত না। অথচ এখন সেই চামড়াপট্টিতে চামড়া নেই।
তিনি বলেন, সময়মতো বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হওয়া, চামড়ার ভালো বাজার না পাওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে চামড়াপট্টিতে বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসা করছে। পেশা বদল করে নেওয়া বেশিরভাগ চামড়া ব্যবসায়ী এখন শুধু ঈদুল আজহাতে মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসেবে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচা করেন।
এ অঞ্চলে চামড়া কেনাবেচার সবচেয়ে বড় হাট হচ্ছে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানার কালিবাড়ী হাট। সপ্তাহে দুদিন অর্থাৎ শনিবার ও বুধবার হাট বসে। চামড়াপট্টি থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবসায়ী চামড়া নিয়ে সেখানে যান। এ ছাড়া লালমনিরহাটের বড়বাড়ি, চাঁপারহাট, রংপুরের তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জেও ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনাবেচা করেন।
চামড়াপট্টি এলাকার একরামুল হক, সেলিম মিয়া, শফি মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন চামড়া ব্যবসায়ী জানান, আগে হাটগুলোতে রিলায়েন্স, বিএলসি, আরকে লেদার, আজমেরি লেদার, পান্না লেদার, মুক্তা ও মুক্তি ট্যানারিসহ বিভিন্ন ট্যানারির প্রতিনিধিরা আসতেন। এখন তাদের সংখ্যা কমে গেছে। যারা হাটে আসেন তাদের মধ্যে সিন্ডিকেট রয়েছে।
কোনো কারণে যদি একটি ট্যানারির প্রতিনিধি হাটে না আসে, তাহলে চামড়ার দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগ থাকে না। ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়। তখন বেশি দামে চামড়া কেনা থাকলেও কম দামে বিক্রি ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
আকমাল হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী জানান, চামড়া সংরক্ষণ করে রাখবেন সেই সুযোগ নেই। নগদ দামে চামড়া কিনে বেশ কিছু টাকা বাকি রেখে ট্যানারিগুলোতে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্য বকেয়া টাকার বিপরীতে কোনো প্রমাণাদি তাদের কখনো দেওয়া হয় না। অতীতে প্রসিদ্ধ ট্যানারি মালিকের মৃত্যুর কারণে চামড়াপট্টির অনেক ব্যবসায়ীর বকেয়া লাখ লাখ টাকা আজও তুলতে না পেরে মূলধনের অভাবে পথে বসে গেছেন।
মূলত সুষ্ঠুভাবে মনিটরিং না থাকায় চামড়া শিল্পে ধস নেমেছে বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই। বিশেষ করে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরে প্রভাব পড়েছে। ১৫০ এর বেশি ট্যানারির মধ্যে সাভারে এখন চালু হয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১২টি। এ কারণে ঢাকাতেও চামড়া কেনার চাহিদা কম। আর ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীদের অনেকেই আগের পাওনা টাকা পাননি। এখন নগদ টাকায় চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের ভয়ে আছেন তারা। এ কারণে অনেকেই চামড়া কিনবেন কি না তা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন।
চমড়া ব্যবসায়ী শামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণে বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম তো বেড়েই চলেছে। এত কিছুর মাঝেও ট্যানারি মালিকেরা সরকার থেকে ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছে। আমাদের ঋণ দেওয়া হয় না। অথচ ট্যানারি মালিকেরা চামড়া ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে। এ কারণে দিনের পর দিন ঢাকার বাইরের চামড়া ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের ফাঁদে আটকে আছে।
চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে বর্তমানে অটোবাইক বিক্রি করছেন আরিফ হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চামড়া বিক্রি করে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও বকেয়া টাকা তুলতে পারিনি। তাই বাপদাদার চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। শুধু আমি নই, আমার মতো অনেকে পুঁজি হারিয়ে আজ পথে বসেছে। পেটের তাগিদে এখন ধার-দেনা করে অটোরিকশার ব্যবসা করছি।
এদিকে চামড়ার ব্যবসা না থাকায় স্থানীয় শ্রমিকরাও পড়েছেন বিপাকে। এখন সামান্য আয়ে সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান আজিজুল ও আবেদ আলী নামে দুই চামড়া শ্রমিক। তারা জানান, আগে চামড়ার রমরমা ব্যবসা ছিল। এখন সেই সুদিন নেই। চামড়ার গুদাম কমে যাওয়ায় এখন আগের মতো আয় হয় না। আগে যেখানে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হতো, এখন ২০০ টাকারও হয় না।
চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে নারাজ ট্যানারি মালিক ও তাদের প্রতিনিধিরা। নাম না প্রকাশের শর্তে এক ট্যানারির প্রতিনিধি ঢাকা পোস্টকে জানান, গত বছর রংপুরে চামড়া আমদানি খুবই কম ছিল। এবারও একই শঙ্কা রয়েছে। তবে রংপুরের চামড়া ব্যবসায়ীরা যারা বিগত মৌসুমের টাকা পাবেন, তাদের এবার টাকা পরিশোধ করে নতুন করে চামড়া কিনতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার এ বছর গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুটে পাঁচ টাকা দাম বাড়িয়েছে। এবার ঢাকাতে প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ১৫ থেকে ১৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ছাগলের চামড়ার দাম এবার দুই টাকা বাড়ানো হয়েছে। এই দামে চামড়া কেনা-বেচা সম্ভব নয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
ভালো দাম না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় বর্তমানে চামড়া ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। এমনিতে দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।
এসপি