মোবারক হোসেন

ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে পাকবাহিনীর এ দেশীয় দোসর ( রাজাকার) হিসেবে কাজ শুরু করেন মোবারক হোসেন (মবা)। সেখান থেকে দুই সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে ১৫ দিন পর তিনটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ২০ বক্স গুলিসহ পালিয়ে যোগ দেন দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলার বেসামরিক সংগঠন 'পলাশডাঙ্গা যুব শিবির হয়ে তিনটি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যুদ্ধ শেষে সংগঠনের প্রধান প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ মির্জা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির সনদ দিয়েছিলেন তাকে। 

কিন্তু অবহেলায় সেই সনদটি হারিয়ে যায়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা পাওয়ার জন্য তার সরকারি কোনো দপ্তরে আবেদন করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিনমজুরের কাজ করে স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে কোনোমতে চলছিল সংসারের চাকা। কিন্তু আশির দশকের শেষের দিকে একটি দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করার পর থেকে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেঁচে নেন। 

মোবারক হোসেনের বাড়ি পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পাথরঘাটা গ্রামে। সতিনি ওই এলাকার মৃত মো. রুস্তম সরকারের ছেলে।

বর্তমানে মোবারক হোসেনের বয়স ৭৭ বছর। বয়সের ভারে চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। আশেপাশের এলাকায় ভিক্ষা করে স্ত্রী ও নিজের ভরণপোষণ করেন।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২৭ বছর বয়সী মোবারক হোসেন অত্যন্ত বেপরোয়া প্রকৃতির যুবক ছিলেন। এলাকার মানুষ তাকে দুর্ধর্ষ মবা বলে ডাকতো। এ কারণে মোবারক হোসেনকে এলাকার মানুষ ভয় করতেন আবার সম্মানও করতেন। এ অবস্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মোবারক হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান।

মোবারক আলী বলেন, পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে রাইফেল ও গুলি নিয়ে পালিয়ে এলে আব্দুল লতিফ মির্জা আমাকে বুকে ধরে আলিঙ্গন করেন। সেদিনের কথা আমি ভুলতে পারিনা। 

যুদ্ধের স্মরণীয় মুহূর্ত নিয়ে তিনি বলেন, নওগাঁ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ওই যুদ্ধে ৪৫টি নৌকা নিয়ে পাকিস্তানের প্রায় তিন শতাধিক সৈন্য নওগাঁ বাজার আক্রমণ করেছিল। পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা পরদিন আবারও নওগাঁ বাজারে হামলা চালায়। প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে মুক্তিবাহিনীর গুলি ফুরিয়ে গেলে আমরা সরে যেতে বাধ্য হই। এদিন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পাই আমিসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।

সেখান থেকে পালিয়ে আমরা কয়েকজন ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের পরমানন্দপুর গ্রামে হদু হাজির বাড়িতে আশ্রয় নিই। এরপর পুরো নওগাঁ বাজার এলাকা পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। দেশ স্বাধীনতার পরে আব্দুল লতিফ মির্জা আমাকে সনদ দিয়েছিল। কিন্তু আমার মা ঘর পরিষ্কার করার সময় সনদটি হারিয়ে ফেলে। তাই আর ভাতার জন্য কোথাও আবেদন করতে পারিনি।

জীবন যাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্থাভাবে দিন কাটাই। এর ওপর গ্রামের একটি বাড়িতে কাজের সময় দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেলে কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। পরে মানুষের কাছে হাত পেতে ও ধারকর্জ করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পঙ্গুত্বের পর থেকেই নিজের ও স্ত্রীর খাবার জোগাড় করতে ভিক্ষা শুরু করি। এখন চেয়ারম্যানের দেওয়া বয়ষ্ক ভাতা ও ভিক্ষা করে জীবন চালাই। তবে বয়সের ভারে ভিক্ষা করতেও কষ্ট হয়।

পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেদায়াতুল্লাহ হক বলেন, গ্রামের প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনেছি মোবারক হোসেন খুব সাহসী যুবক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে রাইফেল ও গুলি নিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করে আসছি। তার জন্য স্থায়ী কোনো আবাসন ব্যবস্থাসহ আর্থিকভাবে যেন সে চলতে পারে সেই ধরনের সহযোগিতা করা দরকার।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মোকসেদ আলী বলেন, এই উপজেলার অনেকেই সিরাজগঞ্জ জেলার বেসামরিক সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে তাদের সকলের নাম ও পরিচয় ভাঙ্গুড়া উপজেলা কমান্ড কাউন্সিলের কাছে নেই। তাই মোবারক হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলেও আমাদের জানা নেই। তবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাকে সেইভাবে মর্যাদা দেওয়া দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ’৭১ পাবনা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযুদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও আজ স্বীকৃতি পায়নি বা ভাতা পায়নি, এটা বড়ই আফসোস। তবে তার খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে বলে জানান।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক মানুষ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। বীরের কাতারের মানুষ। তাই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন খুবই কষ্টদায়ক। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে মোবারক হোসেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলে সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাকি বিল্লাহ বলেন, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নিশ্চয় মহান ব্যক্তি। তাকে বঞ্চিত করা অনুচিত। আমার গ্রামের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি হওয়ার কারণে আমি ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শুনেছি, সে রাজাকার বাহিনী থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিছু বছর গ্রাম থেকে মসজিদের চাল উঠিয়ে একটা কমিশনে সে জীবিকা নির্বাহ করতে। মাঝখানে অচল (হাটাচলা করতে পারে না) হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি ভিক্ষা করে জীবনযাপন করে। এটা শুনেছি, শুনে কষ্ট পেয়েছি। আমরা সব সময় তাকে সহযোগিতা করে আসছি। 

তিনি আরও বলেন, তার জন্য স্থায়ীভাবে একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। ইনশাল্লাহ শিগগিরই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।

এসপি