‘ভারত থাকি পানি ছাড়ছে। এক রাইতোতে নদীত পানি ঢুকি একাকার হইছে। রাইতোতে হু হু করি নিচা জাগাত (নিম্নাঞ্চল) পানি সোন্দাইছে (ঢুকে পড়া)। এ্যালা তো চাইরোপাকে (চারদিকে) পানি আর পানি। কোনোটে কোমরপানি, কোনোটে ফির হাঁটুপানি। কাইল সারা রাইত নিন (ঘুম) হয় নাই।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কৃষক আশরাফুল আলম। থাকেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী লক্ষ্মীটারি ইউনিয়েনের বাগেরহাট এলাকায়। উজানে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অভিন্ন এই নদীর ভারতীয় অংশে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিস্তা ব্যারাজের ৬৫ কিলোমিটার উজানে ভারত গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের অংশে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তা তীরবর্তী গঙ্গাচড়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা।

গত সপ্তাহে বৃষ্টির পানি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে কিছু এলাকা প্লাবিত হলেও দু-তিন দিনের মধ্যে পানি নেমে যায়। শুকাতে থাকে পানিবন্দি পরিবারগুলোর বসতবাড়ির আঙিনা। কিন্তু কাঁদামাটি শুকাতে না শুকাতেই বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) রাতে হঠাৎ তিস্তায় পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীপাড়ের গ্রামগুলোতে অকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে।

এবার পানির তোড়জোড়ে উপজেলার আলমবিদিতর, লক্ষ্মীটারি, কোলকোন্দ, নোহালী ও গজঘণ্টাসহ পাঁচ ইউনিয়নের প্রায় দশ-বারো হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াতে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। অনেক পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিলেও এখনো অনেকেই পানির মধ্যে অবস্থান করছে।

শুক্রবার (৯ জুলাই) সকালে লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের বাগেরহাট এলাকায় গেলে সেখানে কথা হয় আশরাফুল আলম নামের ওই কৃষকের সাথে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌‘সকাল থাকি ‌পানি একনা নামি গেইছে। কিন্তু হামার দুর্ভোগ তো কমোচে (কমছে) না। চৌকির ওপর টিভি, হাঁড়িপাতিল, বিছানাসহ মালামাল তুলি থুইছি। অন্যটে যে আশ্রয় নেবার যামো, সেই জায়গাও তো নাই।’

সরেজমিনে দেখা যায়, কোলকোন্দ ইউনিয়নের পূর্ব বিনবিনা চর হতে লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলী সংযোগ বেড়িবাঁধটি ভেঙে গেছে। এতে বাগেরহাট বাজার এলাকাসহ আশ্রয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে আছে হাজারো মানুষ। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগে বালু ভরাট করে রাখলেও তা ভাঙন স্থানে না ফেলায় মানুষজনের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

এর আগের ভাঙনে ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিনবিনার স্বেচ্ছাশ্রমের বাঁধটি ও পূর্ব বিনবিনার ভাঙা মসজিদ বিলীন হয়েছে। এবার আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়ায় লক্ষ্মীটারির কেল্লারপাড় চরে স্বেচ্ছাশ্রমের উপবাঁধটিও ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙনে পূর্ব বিনবিনা ও পশ্চিম ইচলীর ১৭টি পরিবারের বসতবাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়।

এদিকে প্লাবিত গ্রামগুলোর রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। নদীর কোলঘেঁষা এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মসজিদ ও আবাদি জমি ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে। পানিবন্দি মানুষ রাস্তাসহ উঁচু স্থানে পলিথিনের ছাউনি তৈরি করে গরু-ছাগল ও আসবাবপত্র নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

বন্যাকবলিত কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, উত্তর চিলাখাল, সাউথপাড়া, মটুকপুরসহ চার গ্রামের কমপক্ষে তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের চরইশরকুল, ইছলি, পূর্ব ইছলি, পশ্চিম ইছলি ও শংকর, বাগেরহাটহ ছয়টি গ্রামের সাড়ে ৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।

একই অবস্থা নোহালীর মিনার বাজার, কচুয়াচর, বৈরাতী বাাঁধের ধার, চর নোহালী, বাগডহরা চর, মর্নেয়া ইউনিয়নের মর্নেয়া চর, তালপট্টি, আলাল চর, নরসিংচর, গজঘণ্টা ইউনিয়নের কালিরচর, ছালাপাকসহ আলমবিদিত ও গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের তিস্তাবেষ্টিত নিম্নাঞ্চল এলাকায়। এসব এলাকায় আরও সাড়ে ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।

পশ্চিম ইচলীর ফজলু মিয়া বলেন, ‘চার-পাঁচদিন আগে পানিবন্দি হয়ে ছিলাম। সেই পানি না শুকাতে না শুকাতে আবারও পানিবন্দি হলাম। আমাদের কষ্টের জীবন। এভাবেই চলছে। বৃষ্টি নাই। এক রাইতোতে হঠাৎ পানি উঠিল। শুকনা জাগাও নাই যে সেটে (সেখানে) যায়া উঠমো।’

কেল্লারপাড়ের মহির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যতদিন নদীর কাজ হবার নায়, ততদিন হামার কপাল থাকি দুঃখ শেষ হবার নায়। খালি তো শুনি, সরকার নাকি চীনের সাথে চুক্তি করছে। তিস্তায় নাকি অনেক কিছু হইবে, কিন্তুক কিছুই হইলে না। আর কত ভাঙন, ক্ষয়ক্ষতি আর ধ্বংস দেখলে সরকার হামার বাঁচাবার জনতে কাজ করবে?’  

লক্ষ্মীটারি ইউনিয়ন পরিষেদের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল হাদী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌ভারত পানি ছেড়ে দেওয়ায় এক রাতেই তিস্তার ভাটি অংশে পানিতে ভরে উঠল। আমার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের এখন শুকনা খাবার প্রয়োজন, বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন।

কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব আলী রাজু ঢাকা পোস্টকে জানান, পানি বৃদ্ধির তার ইউনিয়নের বিনবিনা চরে সাত পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন ৩ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর আগে ৫৭৫ পরিবারকে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়।’

পাউবোর নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। শুক্রবার বেলা ১১টায় কিছুটা কমে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। তিস্তা ব্যারেজের সবকটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর