প্রাণ হাতে নিয়েই পাহাড়ে বসতি গাড়ে তারা
কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে দেখা দিয়েছে পাহাড় ধসের আশঙ্কা। ফলে আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা আর ঝুঁকিতে রয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। পাহাড়ি জেলায় সমতল ভূমির অপ্রতুলতা। তাই বসবাসের নিরাপদ জায়গা না থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই তারা পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গাড়ে বারবার।
জানা গেছে, জেলা সদর, লামা, রোয়াংছড়ি, থানছি, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি ও রুমা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে লক্ষাধিক মানুষ। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রতিবছর নতুন নতুন বসতি গড়ে ওঠায় গত বছরের তুলনায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের সংখ্যা এ বছর অনেক বেড়েছে।
বিজ্ঞাপন
আবহাওয়া অফিস বলছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ু অব্যাহত থাকার কারণে এ বৃষ্টি চলমান থাকবে। তাই এখনই পাহাড়ের ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কর্তন এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বিভিন্ন ঝিরি ঝরনা থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে টানা বর্ষণ হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বিভিন্ন সড়কের দুপাশের মাটি সরে গেছে ও পাহাড়ের অনেক জায়গায় দেখা দিয়েছে ছোট-বড় ফাটল। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকলে যেকোনো সময় পাহাড়ের মাটি ধসে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
অন্যদিকে আবহাওয়া অফিস বলছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ু অব্যাহত থাকার কারণে এ বৃষ্টি চলমান থাকবে। তাই এখনই পাহাড়ের ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
বান্দরবানের মৃত্তিকা কর্মকর্তা মাহাবুব আলম জানান, পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ, অপরিকল্পিত বৃক্ষনিধন ও পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা পাথর উত্তোলনের কারণে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। ফলে টানা বৃষ্টি হলেই মাটি ধসে পড়ছে। এ ছাড়া নদী, ছড়া ও খাল থেকে পাথর উত্তোলনের কারণে পার্বত্যাঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এখনই সতর্ক না হলে পাহাড় ধসে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে এই অঞ্চলে।
এর আগে দেখা গেছে, প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্ষা শেষে আবারও তারা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস শুরু করে।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো থেকে লোকজনদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হচ্ছে। সরিয়ে নিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে কুইক রেসপন্স টিম তৈরি করা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন তৎপর রয়েছে
ঝুঁকিতে থাকা কালাঘাটার মো. আলী হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগে আমি অনেক কষ্ট করে এ জায়গাটি কিনে জঙ্গল ছাঁটাই করে ঘর তৈরি করেছি। কিন্তু এখন প্রতিবছর বর্ষায় আমি পরিবার নিয়ে ভয়ে রাত যাপন করি। তবে এখনো আমাদের এখানে বড় ধরনের সমস্যা না হলেও এবারের টানা বর্ষণে আতঙ্কে আছি।
কিন্তু কী করব? যাব কোথায়? এমন প্রশ্ন রেখে বান্দরবান পৌরসভার ইসলামপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ লিয়াকত আলী বলেন, বর্ষা এলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরে যেতে বলে, কিন্তু কোথায় যাব? আশ্রয়কেন্দ্রে কয়দিন থাকব? গরিব মানুষ আমরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাই ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাস করি। সরকার স্থায়ী কোনো সমাধান করে দিলে সেখানে চলে যাবেন বলেও জানান অনেকে।
পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে সাতটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দুর্ঘটনার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো থেকে লোকজনদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হচ্ছে। সরিয়ে নিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে কুইক রেসপন্স টিম তৈরি করা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
উল্লেখ্য, পাহাড় ধসে বান্দরবানে ২০০৬ সালে জেলা সদরে ৩ জন, ২০০৯ সালে লামা উপজেলায় শিশুসহ ১০ জন, ২০১০ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৫ জন, ২০১১ সালে রোয়াংছড়ি উপজেলায় ২ জন, ২০১২ সালে লামা উপজেলায় ২৮ জন ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১০ জন, ২০১৫ সালে লামায় ৪ জন, সিদ্দিকনগরে ১ জন ও সদরের বনরূপা পাড়ায় ২ জন এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৩ জুন সদরের কালাঘাটায় ৭ জন ও রুমা সড়কে ২৩ জুলাই ৫ জন পাহাড় ধসে মারা গেছেন।
এনএ