রোগীদের তাৎক্ষণিক সেবা দিচ্ছেন ভলান্টিয়ার চিকিৎসক
সোমবার (৫ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টা। রংপুর পুরাতন সদর হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মানুষের আনাগোনা। সেখানকার ডেডিকেটেক করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের প্রবেশপথে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের স্বজন। কারও হাতে ওষুধ, কারও হাতে খাবারসহ পানির বোতল। দায়িত্বরত কর্মচারীদের মাধ্যমে নাম, ঠিকানা, শয্যা ও ফোন নম্বর লিখে সেসব ভেতরে পাঠাচ্ছেন তারা।
তাদের মধ্যে ইউসুফ নামের এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টেকে জানান, সংকটাপন্ন অবস্থায় শনিবার (৩ জুলাই) তার চাচাকে করোনা হাসপাতালে ভর্তি করান। ভর্তির সময়ে বন্ড দিয়ে ভর্তি করাতে হয়। কারণ, রোগীর আইসিইউ শয্যা, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার প্রয়োজন হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে না। ভর্তির সময় আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না। এখনো নেই। বরং সেখানে রোগীর চাপ বেড়েছে। তবে চিকিৎসকের আন্তরিকতা ও সেবার মান ভালো হওয়ায় তার চাচার সংকটাপন্ন পরিস্থিতি কাটিয়ে এখন শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে তিনি জানান।
বিজ্ঞাপন
হাসপাতালের প্রবেশপথে দেখা মেলে চার তরুণ চিকিৎসকের সঙ্গে। তারা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক। করোনা হাসপাতালে ভলান্টিয়ার চিকিৎসক নেওয়া হবে জেনে স্বেচ্ছায় সেবা দিতে ছুটে এসেছেন তারা। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে দেখা করে কাজে যোগদানের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ফিরছিলেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে ইন্টার্ন চিকিৎসক রেজওয়ান, আকিব, সুমন ও মুদাস্তির জানান, করোনা হাসপাতালে চিকিৎসক-সংকট। জনবল না থাকায় ভলান্টিয়ার চিকিৎসক চেয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুন-নবী নাহিদ তার ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট করেছেন। সেই পোস্টে সাড়া দিয়েই তারা করোনা রোগীদের স্বেচ্ছায় চিকিৎসাসেবা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল বিভাগের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল। এ ছাড়া করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১৮ আইসিইউ শয্যা রয়েছে দিনাজপুর এম এ রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও (রমেক) রয়েছে ২০ শয্যার আইসিইউ। কিন্তু পুরো বিভাগে প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষের জন্য আইসিইউ শয্যা মাত্র ৪৮টি। প্রতিদিন হু হু করে আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুর সারিও বাড়ছে। রয়েছে আইসিইউ শয্যা পেতে স্বজনদের হাহাকার।
বিভাগের আট জেলার মানুষের ভরসা বিশেষায়িত এই করোনা হাসপাতাল ঘিরে। কারণ চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও চিকিৎসার সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু এখানেও ফাঁকা নেই সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা। রোগী ভর্তির কোটাও পরিপূর্ণ। প্রয়োজনের তুলনায় রয়েছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সুবিধা। এ হাসপাতালে সংকট শুধু জনবলের। এ কারণে ভলান্টিয়ার চিকিৎসক খুঁজছেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের এপ্রিলে ১০টি আইসিইউ নিয়ে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে আইসিইউর মধ্যে মাত্র আটটিতে ভেন্টিলেটর সুবিধা রয়েছে। এ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে ৯১টি শয্যায়। বাকি ৯টিতে গেল বছরেও অক্সিজেন সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
মুমূর্ষু রোগীর কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৬ রোগীর মধ্যে ১০-১৫ জনকে আইসিইউতে নেওয়া জরুরি। কিন্তু পুরো রংপুর বিভাগের কোথাও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্বজনরা। যেন চারদিকে আইসিইউর জন্য হাহাকার চলছে।
এ ব্যাপারে ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুন-নবী নাহিদ ঢাকা পোস্টেকে বলেন, ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে ৩১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। পুরো রংপুর বিভাগে করোনা শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় এখানে রোগীর চাপ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে আরও চিকিৎসক প্রয়োজন। এ জন্য আমরা ভলান্টিয়ার চিকিৎসক খুঁজছি।
তিনি আরও জানান, বিশেষায়িত এই হাসপাতালে ১১৪ জন নার্স ও ৪৫ স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। হাসপাতালটিতে যাত্রার শুরু পর থেকে রোববার পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ২১৭ জন, সংকটাপন্ন ২৬ রোগীকে স্থানান্তর করা হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ১৫৮ জনের।
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ৮ হাজার লিটার অক্সিজেন ধারণক্ষমতা রয়েছে। প্রতিদিন ব্যবহার হয় ৪ থেকে ৫ হাজার লিটার। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে ১৬টি। সেখানে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত করোনা হাসপাতালে নতুন কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। সেখান থেকে কাউকে ছাড়পত্রও দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা না থাকায় অনেকেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন করোনা ইউনিটে ভিড় করছেন।
রমেকের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. মারুফ হাসান ঢাকা পোস্টকে জানান, রোববার থেকে চালু হওয়া নতুন করোনা ইউনিটে সোমবার বেলা একটা পর্যন্ত ১১ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ শয্যা-সুবিধা না থাকলেও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে। ৩১ শয্যার ওই ইউনিটটিতে ৩৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে জানান, ডেডিটেকেড করোনা হাসপাতালে রংপুর অঞ্চলের পাঁচটি জেলার রোগী ছাড়াও দিনাজপুর অঞ্চলের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। এ কারণে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডটিতে আলাদাভাবে করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৫০ শয্যার ব্যবস্থা করা হবে। পুরো জেলায় আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রংপুর জেলায় এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৫৩৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১৮ জন। জেলায় প্রথম ধাপে ১ লাখ ৬৮ হাজার এবং দ্বিতীয় ধাপে ৯০ হাজার মানুষকে করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এনএ