শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিকাশ প্রতারক চক্র
পাবনার বেড়া উপজেলার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একটি প্রতারক চক্র বিকাশে জমা হওয়া উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারকচক্র এ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদেরকেই টার্গেট করছে। এসব শিক্ষার্থী সহজ-সরল ও কিছুটা অসচেতন হওয়ায় সহজেই বিকাশ অ্যাকাউন্টের পিন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য প্রতারকদের দিয়ে দিচ্ছে। গত এক সপ্তাহে উপজেলার অন্তত ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী এই চক্রের ফাঁদে পড়ে তাদের উপবৃত্তির টাকা খুইয়েছে বলে বিকাশ এজেন্টের কয়েকটি দোকান ঘুরে জানা গেছে।
শিক্ষার্থী ও বিকাশ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহ খানেক হলো সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিকাশ অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির টাকা এসেছে। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি ও করোনাকালীন সহায়তা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে পেয়েছে।
বিজ্ঞাপন
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা আসার পর মোবাইলে অপরিচিত নম্বর থেকে প্রতারক চক্রের কল আসে। বলা হয়, ‘হ্যালো আমি বিকাশ থেকে বলছি। আমাদের এখানে সিকিউরিটি প্রবলেম হচ্ছে। আমরা আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেব। তার আগে দেখেন- আপনার অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির টাকা ঢুকেছে কিনা। যদি টাকা ঢুকে থাকে, তবে ওই টাকা আপনি তুলতে পারবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের অফিস থেকে সিকিউরিটি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ না করে নেবেন।’
এ রকম বক্তব্য দিয়েই গ্রামের সহজ-সরল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারকরা কথা শুরু করে। এরপর কথার মার-প্যাঁচে কৌশলে পিন নম্বর সংগ্রহ করে হাতিয়ে নেয় বিকাশ অ্যাকাউন্টের সব টাকা। গত এক সপ্তাহের মধ্যে বেড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় এ ধরনের শতাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে কাশিনাথপুর ও আমিনপুর এলাকার শুধু ছয় থেকে সাতজন বিকাশ এজেন্টের সঙ্গে কথা বলেই অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থীর প্রতারিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার (০১ জুলাই) উপজেলার কাশিনাথপুর ফুলবাগান মোড়ে বিকাশের কাস্টমার কেয়ারের সামনে দাঁড়ানো একাদশ শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী জানায়, বিকাশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি কৌশলে তাদের কাছ থেকে পিন নম্বর নিয়ে উপবৃত্তির সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কারণে তারা এখন বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে এসেছে। কিন্তু এখানে এসে কোনো লাভ হচ্ছে না।
শাহিন আলম নামে একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, গত সোমবার (২৮ জুন) সকালে বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করেছিল। সে সরল বিশ্বাসে ওই ব্যক্তির কথা মতো তথ্য দিয়েছে। তথ্য না দিলে তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছিল। এ ঘটনার কিছু সময়ের মধ্যেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা খোয়া যায়।
কাওছার আহমেদ নামে আরেক শিক্ষার্থী বলে, আমার বিকাশে আগেই কিছু টাকা ছিল। রোববার (২৭ জুন) উপবৃত্তির সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা আসে। সব মিলিয়ে আমার বিকাশে ১০ হাজার টাকা ছিল। করোনার এই দুঃসময়ে এই টাকা আমার ও পরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রতারকরা আমার সব কিছু কেড়ে নিল।’
শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের বিকাশে টাকা আসার খবর প্রতারকদের কাছে কীভাবে গেল? এই চক্রের সঙ্গে স্থানীয় কেউ জড়িত কিনা তা তদন্ত করা প্রয়োজন।
কাশিনাথপুর ফুলবাড়ি মোড়ের বিকাশ এজেন্ট মোহন হক জানান, উপবৃত্তির টাকা ছাড় হওয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে প্রতারক চক্র। প্রতিদিনই তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা টাকা খোয়া যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসছে। তারা শিক্ষার্থীদেরকে কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগের পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের কাশিনাথপুর শাখার ইনচার্জ মো. অপু হোসেন বলেন, কয়েকদিন ধরে আমাদের এখানে এ ধরনের অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ আমরা লিখে রাখছি। কিন্তু আমাদের করণীয় কী আছে? গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন বা অন্যান্য ক্ষেত্রে পিন নম্বর সংরক্ষণে নিজেদের সতর্ক থাকা দরকার।
হাটুরিয়া-নাকালিয়া প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামিম আহমেদ বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আলোচনা করতে শুনেছি। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও জেনেছি। আমার কয়েকজন শিক্ষার্থীর প্রাথমিকের বৃত্তির টাকা আসার কথা আছে। আমি আগেই তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছি।
নাকালিয়া সাড়াশিয়া বণিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত ওসমান বলেন, প্রতারকদের ফোন পেয়ে কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষার্থী আমার কাছে এসেছিল অভিযোগ নিয়ে। আমি তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছি। বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষক পাঠিয়ে সতর্ক করার ব্যবস্থা করছি।
বেড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খবিরউদ্দিন বলেন, কোনো শিক্ষার্থী যাতে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা না দেয় সে ব্যাপারে আমরা সব স্কুলের শিক্ষকদের মেসেজ দিচ্ছি। শিক্ষকেরা দ্রুত এ বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেবেন।
এ ব্যাপারে আমিনপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন আলী বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। আসলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সবুর আলী বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মামলা করে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তরের কথাও জানান তিনি। বিকাশ পিন আদান-প্রদানে সবাইকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন ইউএনও।
রাকিব হাসনাত/আরএআর