ঠাকুরগাঁও জেলার জনপ্রিয় একটি আম সূর্যপুরী। আমের জাতের মধ্যে সুমিষ্ট ও সমৃদ্ধ একটি জাত সূর্যপুরী। তবে সূর্যপুরী আমের চাহিদা কমে যাওয়া, অন্যান্য আমের তুলনায় আকারে ছোট হওয়া ও আমে পোকা ধরার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমটি। আগ্রহ হারাচ্ছেন জেলার আমচাষিরা।

জেলার আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে জেলায় আম্রপালি, হিমসাগর, বারি-৪, হাঁড়িভাঙা জাতের আমের সমারোহ। কিন্তু অতিরিক্ত রোদের কারণে আমের গুটি শুকিয়ে যায়। যে কারণে অনেক বেশি খরচ করে আম টিকিয়ে রাখতে প্রয়োগ করতে হয়েছে কীটনাশক। এরপরও ফলন ভালো হওয়ায় খুশি চাষিরা।

সরেজমিনে আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় অনেক বেশি সূর্যপুরী আম চাষ করতেন জেলার আমচাষিরা। তবে এই আম শুধু ঠাকুরগাঁও থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত যাওয়ায় তেমন দাম পেতেন না চাষিরা। ফলন ভালো হলেও বাজারজাত নিয়ে বিপাকে পড়েন তারা। আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা, বারি-৪ জাতের আমের বাজারজাত বেশি ও বাইরে আমগুলোর চাহিদা বেশি থাকায় সূর্যপুরী আম চাষের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হতেন চাষিরা। যে কারণে দিন দিন সূর্যপুরী আমের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারীর ঐতিহ্যবাহী সূর্যপুরী আমগাছেও এবার ধরেনি তেমন আম। ধারণা করা হয়, এ আমগাছটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় আমগাছ। প্রায় ২ দশমিক ৫ বিঘা জমির ওপর বিদ্যমান আমগাছটির বয়স প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি।

উপজেলার হরিণমারীর ঐতিহ্যবাহী সূর্যপুরী আমগাছেও এবার ধরেনি ফলন

জেলা কৃষি অধিদফতরের তথ্যমতে, ঠাকুরগাঁও জেলায় ৫ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। গতবারও ঠিক এমনি জমিতে আমের বাগান করা হয়েছিল। তবে গতবার ৭৫ হাজার ২৭৭ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হলেও এ বছর আমের ভালো উৎপাদন নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় কৃষি অধিদফতর। অন্যদিকে এ বছর এখন পর্যন্ত আমের তেমন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নে কথা হয় আমচাষি আবু সাঈদের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমিতে করছেন আমের বাগান। তার বাগানে আম্রপালি ও হিমসাগর জাতের আম লাগিয়েছেন তিনি। একসময় সূর্যপুরী আম চাষ করতেন। তবে এ আমের চাহিদা না থাকায় এবার মাত্র ২ বিঘায় চাষ করেছেন সূর্যপুরী আম।

গত বছর সূর্যপুরী আম করেছিলাম। কিন্তু চাহিদা না থাকায় আমটি সেভাবে বিক্রি করতে পারিনি। আমটি শুধু আমাদের জেলায় থেকে যায়। যদি আমটি জেলার বাইরে পাঠানো যেত, তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো। আমি এখস যে আমের চাষ করি, এগুলোর দাম বেশি পাওয়া যায়। সূর্যপুরী আমের দর যদি থাকে ৩০ টাকা, তাহলে আম্রপালির ও হাঁড়িভাঙার দাম থাকে ৭০ থেকে ৮০ টাকা-- আমচাষি আবু সাঈদ।

আরেক আমচাষি নূর ইসলাম বলেন, ৪ বিঘা জমিতে আমের বাগান করেছি। এর মধ্যে ২০০ গাছ রয়েছে আম্রপালি, ৭০টি হাঁড়িভা    ঙা। কিছু আছে গোপালভোগ জাতের। এগুলোর ফলন তাড়াতাড়ি আসে। তবে সূর্যপুরী আম লাগাইনি। কারণ এই আমের চাহিদা কম। সহজে এই আমের গ্রাহক পাওয়া যায় না। কিট (পোকা) হয় বেশি, সাইজে ছোট হয়। আমটির যদিও ফলন ভালো হয়, আমরা তেমন লাভবান হতে পারি না।

বাজারে চাহিদা কম থাকলেও আজও সূর্যপুরী আমের বড় বাগান করছেন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়পলাশবাড়ি ইউনিয়নের আমচাষি আব্দুর রহিম। প্রায় ১০ হাজার সূর্যপুরী আমের গাছ রয়েছে তার বাগানে।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৮ বছর ধরে আমি সূর্যপুরী আমের চাষ করে আসছি। কখনো লসের মুখ দেখিনি। আমের ফলন ভালো হয়। বিক্রি করি ভালো। তবে দিন দিন এই আমটি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যার কারণ হলো বাজারে অন্যান্য আমের দাম বেশি হয়েছে। এ জন্য কমবেশি অনেক আমচাষি সেই আমগুলো চাষাবাদ করছেন। যেমন বারি-৪, হাঁড়িভাঙা, আম্রপালি।

যদিও মৌসুমের প্রথমে সূর্যপুরী আমের দাম তেমন থাকে না। তবে শেষের দিকে ভালো দাম পাওয়া যায়। এবার অতিরিক্ত রোদের কারণে আমের গুটি শুকিয়ে গিয়ে পড়ে যায় আম।

সূর্যপুরী আমের পরিচর্যার বিষয়ে তিনি বলেন, এই আমগাছটির গোড়া পরিষ্কার করতে হয়। নিয়ম করে সার দিতে হয়। আগাছা পরিষ্কার করা, কীটনাশন দেওয়া, বিভিন্ন ধরেনের পাউডার দিতে হয়। এ ছাড়া টিএসপি (ড্যাব), পটাশ, সালফার, থিওবিট, সাইফার মেথিন (বিষ), কারবারিল, জিটাবু, এমিস্টার টপের ব্যবহার সঠিক সময়ে করতে হবে। তাহলেই সঠিক ফলন পাওয়া যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবু হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সূর্যপুরী আমটি মূলত ঠাকুরগাঁও জেলার জন্য উপযোগী। এটি জেলার বাইরে যায় না। বাইরে তেমন পরিচিত নয়। যে কারণে বাইরের দিকে আমটির চাহিদা নেই। আম্রপালিসহ অন্য আমগুলোর বাইরে চাহিদা বেশি। দামও ভালো পান চাষিরা। এসব কারণে সূর্যপুরী আম চাষ দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে কৃষি অফিস থেকে প্রতিনিয়ত চাষিদের সঠিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

এনএ