শিক্ষকতা পেশায় জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন আজিজুল হক রশিদ। ছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। পরম মমতা ও যত্নে মানুষ গড়ার মহান দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজ কাঁধে। যে হাতে ছিল কলম আর চোখে ছিল স্বপ্ন, সে চোখে আজ ঘনঘোর অন্ধকার।

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ওলট-পালট হয়ে গেছে আজিজুল হক রশিদের জীবনের গতি। মানুষ গড়ার সেই কারিগর এখন খামারের কর্মচারী। যে হাতে কোমলমতি শিশুদের পাঠদান করাতেন, সে হাতে আজ তিনি গরুকে গোসল করান, খাবার দেন, পরিষ্কার করেন গরুর গোবর।

এদিকে করোনায় অভাব-অনটনের কারণে পরিবারের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাড় করা হয়ে উঠেছে কঠিন থেকে কঠিনতর। কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্য বদল করেছেন পেশা। স্থানীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি গরুর খামারে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, উপজেলার সদর ইউনিয়নের মধ্য পাঁচপাড়া গ্রামের মৃত আজমত আলীর বড় ছেলে আজিজুল হক রশিদ ১৯৯৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। তারপর বিএ পড়া অবস্থায় গড়ে তোলেন মডার্ন কোচিং সেন্টার। ওই সময় কোচিং পরিচালনার পাশাপাশি চাকরির আশায় বিভিন্ন দফতরে দরখাস্ত করতে থাকেন। বেশ কয়েকবার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভা পর্যন্ত পৌঁছালেও চূড়ান্ত নিয়োগ কপালে জোটেনি তার।

কোচিং চালিয়ে সুনাম অর্জন করায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলহেরা একাডেমি’। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো ধরনের দান-অনুদান ছাড়াই শিক্ষার্থীদের বেতনের মাধ্যমেই পরিচালনা করতেন আজিজুল হক।

তবে করোনার ভয়াল থাবা আর সরকারি বিধিনিষেধ মানতে হয়েছে আজিজুল রশিদকে। স্কুল চালু না থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায় করতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম। আর এতে উপার্জন হারিয়ে বিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষকসহ তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন।

পরে উপায় না পেয়ে একটি এলপি গ্যাসের দোকানে কাজ নেন আড়াই হাজার টাকা বেতনে। তাতেও চলছে না সংসার। তিন মাস পর এই কাজ ছেড়ে চাকরি নেন স্থানীয় আবুল কালামের গরুর খামারে। এখান থেকে পাওয়া সাত হাজার টাকা বেতন দিয়ে এখন চলছে স্ত্রী-এক মেয়েসহ তিনজনের সংসার।

এদিকে করোনাকালীন নিজের এমন করুণ পরিণতি হলেও সহকর্মীদের কথা ভোলেননি আজিজুল হক। নিজের তিন শতাংশ জমি বিক্রি করে পরিশোধ করেছেন প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের বেতন আর স্কুল ভবনের ভাড়া। 

আলহেরা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক রশিদ বলেন, স্কুল খোলার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বছর চলে গেছে। এ সময়টায় বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারকর্জ করে চলেছি। চিন্তা করেছি স্কুল তো খুলবেই। কিন্তু যখন দেখলাম এভাবে আর সম্ভব নয়, তাই কোনো উপায় না পেয়ে আমি এ কাজ শুরু করেছি। আর জমি বিক্রি করে শিক্ষকদের বেতন দিয়েছি।

এ ব্যাপারে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাহিদা পারভিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু কেজি স্কুলগুলো শিক্ষার্থীভিত্তিক কার্যক্রম, সেহেতু তারা সরকার থেকে কোনো বেতন পায় না। সে ক্ষেত্রে করোনাকালীন এ সময়টাতে জীবনযাপনে তাদের অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। ব্যাপারটি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি এবং পরবর্তীতে আরও কোনো মিটিংয়ে জানানোর চেষ্টা করব।

এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, আশা করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের ব্যাপারে যেকোনো পদক্ষেপ নেবেন।

এনএ