রংপুরে মডেল মসজিদ কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। এখন চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রথম ধাপে সারাদেশে ৫০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে রংপুর জেলার পাঁচটিসহ বিভাগে আরও ছয়টি মডেল মসজিদ রয়েছে। আর বিভাগের আট জেলায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৬৬টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

এদিকে মসজিদ উদ্বোধনের আগমুহূর্তে দিনরাত কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিকরা। গণপূর্ত অধিদফতর ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা উদ্বোধনের প্রস্তুতি হিসেবে বাড়িয়েছেন কাজের তদারকি।

রংপুর জেলার সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়াও সদর উপজেলা, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জের নির্মাণাধীন মডেল মসজিদ রয়েছে উদ্বোধনের তালিকায়। এ ছাড়া দিনাজপুরের খানসামা ও বিরল, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও সদর উপজেলা এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার মডেল মসজিদের উদ্বোধন হবে।

মসজিদভিত্তিক সমাজের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ইসলামি মূল্যবোধের প্রসার ও ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশ্যে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এতে দেশীয় সম্পদ ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। এতে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা মিলে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে ৬৬টি স্থাপন করা হবে। এর ভেতরে রংপুর জেলায় রয়েছে ৯টি মসজিদ। এ মাসে নির্মাণাধীন মসজিদগুলোর মধ্যে রংপুর বিভাগের ১১টি মসজিদের উদ্বোধন হবে।

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা এসব মসজিদের নির্মাণকাজের দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদফতরের। ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে আগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের আওতায় রংপুরসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রকল্প।

রংপুর নগরের জেলা প্রশাসক কার্যালয়-সংলগ্ন কাচারি বাজার রোডে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে নির্মাণাধীন মডেল মসজিদ কমপ্লেক্সটির কাজ শেষ। এখন নির্মাণশ্রমিকরা ধোয়ামোছাসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এদিকে সদর উপজেলার পাগলাপীরে, পীরগঞ্জের লালদিঘীতে, মিঠাপুকুরের উপজেলা পরিষদ চত্বরে এবং বদরগঞ্জের উপজেলা পরিষদ চত্বরের পাশে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

উপজেলা পর্যায়ের মসজিদগুলো তিনতলা হলেও রংপুর জেলা শহরের মসজিদটি চারতলাবিশিষ্ট। অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী জেলা শহরের প্রতিটি মডেল মসজিদের আয়তন প্রায় ৪০ হাজার বর্গফুট এবং উপজেলার মসজিদগুলোর আয়তন ৩০ হাজার বর্গফুট।

এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক প্রান্ত ইসলাম জানান, ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গণপূর্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ছাড়াও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে বর্তমান সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুরে এসব মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর জন্য জমির ধরনভেদে প্রতিটি মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ কোটি টাকা। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একই আদলে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব মসজিদ হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। নারী-পুরুষদের জন্য থাকবে আলাদা অজু ও নামাজের ব্যবস্থা। থাকবে গ্রন্থাগার, সম্মেলনকক্ষ ও গবেষণাকেন্দ্র।

এ ছাড়া অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা সিঁড়ি থাকবে। হেফজ বিভাগ ও শিশুদের জন্য থাকবে শিক্ষাসুবিধা। পর্যটকদের ভ্রমণসুবিধাও রাখা হবে এসব মসজিদে। এ ছাড়া মরদেহ গোসল করানো, হজযাত্রী ও ইমামদের প্রশিক্ষণের সুবিধা থাকবে। মসজিদের খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম সবাই সরকারি রাজস্ব বেতনভুক্ত হবেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে এসব মসজিদ পরিচালিত হবে।

রংপুরের গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে এ বছর প্রথম ধাপে সারা দেশে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ তালিকায় রংপুরের জেলা শহর, সদর উপজেলা, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার মডেল মসজিদ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব মডেল মসজিদ উদ্বোধন করার পর নামাজের জন্য মসজিদগুলো উন্মুক্ত করা হবে।

জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় নির্মাণাধীন মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। অপরপক্ষে উপজেলা এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ৯০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন বলেও তিনি জানান।

এদিকে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ইসলাম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন স্থানীয় আলেম-ওলামা। সচেতন মহল বলছেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ যৌতুক, মাদক, সন্ত্রাস রোধে মডেল মসজিদ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।

রংপুর নগরীর কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম মুফতি মুহাম্মাদ জাহিদ বিন মাহবুব ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের এই প্রকল্প বিশ্বে প্রথম ও নজিরবিহীন ঘটনা। একসঙ্গে এতগুলো মসজিদ পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সরকার নির্মাণ করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ ও অবদান মুসলিমবিশ্ব ভুলবে না। এসব মডেল মসজিদ শুধু নামাজ আদায় নয়, ইসলামি গবেষণা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

তিনি বলেন, মুসলিমদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিকাশের পাশাপাশি ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণা আরও বাড়বে। মডেল মসজিদকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে। শুধু তা-ই নয়, আলেম-ওলামাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে সরকারের এই প্রকল্প।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কৃষিবিদ নূরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, ধর্মপ্রাণ মানুষ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জনে লাইব্রেরি থেকে সুবিধা পাবে। গবেষকদের জন্য গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সারা দেশে হাজার হাজার মুসল্লি দীনি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পাবেন। অনেকেই কোরআন শরিফ হিফজ করার সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া সরকারের এই প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা তৈরি হবে।

তিনি বলেন, মুজিব বর্ষে বিভাগে ৬৬টি মসজিদের মধ্যে ১১টির উদ্বোধন করা হবে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ৫টি, দিনাজপুরে ২টি, পঞ্চগড়ে ২টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি, লালমনিরহাটে ১ মসজিদ রয়েছে। জেলা পর্যায়ের মসজিদগুলো চারতলা এবং উপজেলা পর্যায়ে তিনতলাবিশিষ্ট। এসব মসজিদের পরিবেশ বেশ মনোরম হবে। মসজিদের ভেতরে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা নামাজ আদায় করতে পারবেন। প্রতিটি মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি আলাদা অফিস থাকবে। অতিথি ও বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণসুবিধাও রাখা হবে মসজিদে।

মসজিদে জনবল নিয়োগ প্রসঙ্গে নূরুল ইসলাম বলেন, উদ্বোধনের পর এই মসজিদগুলোর দেখাশোনার দায়িত্ব পাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী এসব মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিবসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে অনেকগুলো মসজিদে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।

উদ্বোধনের ব্যাপারে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলায় মোট নয়টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী রংপুরের পাঁচটি মসজিদের উদ্বোধন করবেন। বাকি চারটিও খুব দ্রুত উদ্বোধন করা হবে। বর্তমানে প্রথম ধাপের পাঁচটি মসজিদ উদ্বোধনের জন্য ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার একসঙ্গে ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণ করছে। শুরুতে প্রকল্পটি সৌদি সরকারের অর্থায়নে হওয়ার কথা ছিল। পরে সৌদি আরব এ বিষয়ে নীরব থাকায় ধর্ম মন্ত্রণালয় নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ইতোমধ্যে ৫৬০টি মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে ৪০০টির কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্বে এই প্রথম কোনো সরকার একসঙ্গে ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণ করছে।

এনএ