শত শত গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করছে না সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। টাকা পেতে আদালতে মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান (স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোন) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত নয়টি মামলায় ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, বিমা কোম্পানিটির মালিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। অন্যদিকে, বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও গ্রাহকরা বিমার সমুদয় টাকা আদায় করতে পারছেন না। উল্টো গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ১০ বছর মেয়াদি জীবন বিমা পলিসি করেছেন এমন একজন হলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মনিরুজ্জামান ডাবলু । মেয়াদপূর্তির পর এক টাকাও পাননি তিনি। আদালত ও বিমা কোম্পানিতে ঘুরতে ঘুরতে চার বছর পার হয়েছে। তার মতো আরেক ভুক্তভোগী দৌলতপুর উপজেলারই মুক্তার হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে ১০ বছর মেয়াদি জীবন বিমা পলিসি করেছিলাম। মেয়াদপূর্তির পর তারা টাকা দিচ্ছে না। কথা ছিল মেয়াদপূর্তি হলে একবারে ডাবল (দ্বিগুণ) টাকা দেবে। কিন্তু এখনও কোনো টাকা দেয়নি, উল্টো হয়রানি করছে। তাদের কাছে ঘুরতে ঘুরতে যখন কোনো কাজ হলো না তখন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।’

অপর এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করে বলেন, পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় সাত বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু এখনো এক টাকাও পাইনি। ডাবল টাকা তো দূরের কথা, আসল টাকাই ফিরে পাচ্ছি না।

এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ

‘বাংলাদেশের অনেক বিমা কোম্পানি ভুয়া। ভেবেছিলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স নিরাপদ। কারণ, তিনি সরকারের মন্ত্রী। এজন্য কোম্পানির অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে বিমা করেছিলাম। কোম্পানির কর্মীরাও আমাদের বুঝিয়েছিল যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এখানে কোনো সমস্যা হবে না। পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হলেই পাওয়া যাবে ডাবল টাকা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলে এখন টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। অনেক সময় হুমকির সম্মুখীনও হতে হচ্ছে’— অভিযোগ ওই ভুক্তভোগীর।

মামলার আসামিরা হলেন- সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রুবিনা হামিদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. নূরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসলাম রেজা, অডিট অফিসার মো. সাইদুর রহমান খান ও কোম্পানি সচিব মো. রবিউল ইসলাম। দুজনের নাম জানা যায়নি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন অনেক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা কিছু চাই না। নিয়ম অনুযায়ী পাওনা টাকা দিলেই আমরা খুশি। ক্ষমতাবান বলেই আজ আমাদের কোনো মূল্য দিচ্ছে না। সরকারের কাছে আমরা এর বিচার চাই।

এ নিয়ে কুষ্টিয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (দৌলতপুর) আদালতে দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের হাকিম জোয়ার্দ্দারের ছেলে বশির আহমেদ, একই ইউনিয়নের মো. শামসুর রহমানের ছেলে হাবিবুর রহমান ও মনিরুজ্জামান ডাবলু বাদী হয়ে পৃথক মামলা দায়ের করেন।

মামলার আসামিরা হলেন- সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রুবিনা হামিদ (স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোন), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসলাম রেজা, অডিট অফিসার মো. সাইদুর রহমান খান ও কোম্পানি সচিব মো. রবিউল ইসলাম।
 

এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী আব্দুল মতিন খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রাহক প্রতারণায় কোম্পানির চেয়ারম্যান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট (পরোয়ানা) জারি করেন কুষ্টিয়ার আদালত। এখন পর্যন্ত আমার কাছে এ সংক্রান্ত মোট ১১টি মামলা আছে। মোট গ্রাহক ৪৯৭ জন। মোট অর্থের পরিমাণ ৯০ লাখ ৬২ হাজার ৯২৬ টাকা। নয় মামলাতে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। দুটি মামলা লকডাউনের জন্য স্থগিত আছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলার ওয়ারেন্ট চলে গেছে।

বিমা দাবির টাকা পেতে কুষ্টিয়ার আদালতে শরণাপন্ন হন ভুক্তভোগীরা

‘ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের অফিস রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত। কুষ্টিয়া থেকে বনানী থানায় ওয়ারেন্ট গেলেও একটিরও তামিল হয়নি’— যোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের। তিনি বলেন, কুষ্টিয়ার বিষয়ে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। করোনার কারণে কিছু ল্যাকিং (ঘাটতি) তৈরি হয়েছিল। আশা করি আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।

‘কোম্পানির আগের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে বেশকিছু বিমা দাবি আটকে ছিল। আমরা ইতোমধ্যে ৩-৪টি মামলার দাবিগুলো পরিশোধ করেছি। লকডাউনের কারণে কিছু মামলার দাবি পরিশোধ করতে পারিনি। আজ (সোমবার) শুনেছি, আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা। আমরা দ্রুত এ বিমা দাবিগুলো পরিশোধ করব’— যোগ করেন তিনি।

এদিকে, শত শত গ্রাহকের দাবি করা অর্থ পরিশোধ না করায় চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন বিমা কোম্পানিটির মাঠকর্মীরা। নাম প্রকাশ না করে কোম্পানিটির কয়েকজন কর্মী বলেন, এ এলাকায় শত শত গ্রাহক বছরের পর বছর টাকা পাচ্ছেন না। গ্রাহকরা দল বেঁধে কখনো অফিস ঘেরাও করছেন, কখনো আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন। কখনো বা টাকা আদায়ে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী বা প্রভাবশালীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। অবস্থা এমন, পাওনাদার গ্রাহকদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ও সার্ভিস সেল ইনচার্জরা।  প্রতিদিনই অফিসে ভিড় করছেন শত শত গ্রাহক।

কুষ্টিয়ার আদালত থেকে বের হয়ে আসছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী

এমন পরিস্থিতি সামলাতে মাঠকর্মীরা ঠিক মতো অফিসও করতে পারছেন না। কুষ্টিয়ার সার্ভিসিং সেলের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই। প্রতিদিন শত শত গ্রাহককে সামলাতে হয়। অফিসের সামনে গ্রাহকরা বসে পড়েন। টাকা না দিলে যাবেন না। তখন পালানো ছাড়া উপায় থাকে না।

‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বললে তারা বলেন, সামলান। নতুন প্রিমিয়াম নেন, গ্রাহকদের টাকা দেন। প্রধান কার্যালয়ে গ্রাহকদের তালিকা নিয়ে দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও কাজ হয় না। আমরা তো মালিকদের কাছে যেতে পারি না। কী করব, কূল-কিনারা পাচ্ছি না’— যোগ করেন তারা।

সারাদেশে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে ৩০ কোটি টাকার বেশি পাওনা হয়েছে গ্রাহকদের। কুষ্টিয়া ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইলসহ আরও কয়েকটি জেলায় গ্রাহকরা মামলা করেছেন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। সেসব মামলার কয়েকটিতে ওয়ারেন্টও জারি হয়েছে।

এমআই/এমএআর/