সিলেটে পরপর ছয়বার ভূমিকম্পের কারণে তালিকাভুক্ত ২৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আগামী ১০দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। জনগণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব ভবনে অবস্থানরতদের নিরাপদে সরে যেতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রোববার (৩০ মে) বিকেল ৩টায় সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালিয়ে ভবনগুলো বন্ধ ঘোষণা করেন। শুরুতে সিলেটের বন্দরবাজার সিটি সুপার মার্কেটে গিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে ১০ দিন সবকিছু বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলে ব্যবসায়ীরা একমত হয়ে বন্ধ রাখার বিষয়টি মেনে নেন। 

এর আধাঘণ্টা পর সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকার মধুবন সুপার মার্কেটে গিয়েও মার্কেটটি ১০ দিন বন্ধ রাখার আহ্বান জানান ‍তিনি।

তবে ওই সময় মধুবন সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আনা মিয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে ৭ দিন বন্ধ রাখার জন্য মেয়রের কাছে প্রস্তাব রাখেন। তবে ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, যেহেতু মার্কেটটিতে ৩০০ দোকান রয়েছে, এতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। সেক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে এর দায়দায়িত্ব কে নেবে সুতরাং ৭ দিন বন্ধ রাখতে পারলে বাকি ৩ দিনও বন্ধ রাখা সম্ভব। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা বিষয়টি মেনে নিয়ে মার্কেট বন্ধের প্রস্তুতি নেন। এরপর সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকার আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রাজাম্যানশনও ১০ দিন বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দিয়ে আসেন।

এর আগে গত শনিবার (২৯ মে) ভূমিকম্পের কারণে সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকার পল্লবী আবাসিক এলাকার দুটি ছয়তলা ভবন হেলে পড়ে। রোববার (৩০ মে) বিকেল সোয়া ৪টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ওই সময় ভবনের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি। পাশাপাশি প্রকৌশলীরা পর্যবেক্ষণ করেন ওই ভবনটি।

সিলেটে গত শনিবার সকাল থেকে রোববার ভোর ৪টা পর্যন্ত ৬ বার মৃদু ও মাঝারি ভূমিকম্পের কারণে জনগণের ক্ষয়ক্ষতি রোধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সিসিক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কাছাকাছি সময়ে একাধিকবার ছোট ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার ঘটনায় ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা সিলেট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এজন্য বহুতল ভবনের বাসিন্দাসহ নাগরিকদের অন্তত এক সপ্তাহ সতর্ক থাকতে বলেছেন তারা। 

ভূ-তত্ত্ববিদদের এ পরামর্শের ভিত্তিতে সিসিকের তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ২৪টি সরকারি বেসরকারি ভবন ও বিপনী বিতান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দিবাগত রাত ৪রটা পর্যন্ত ৬ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। 

ভূমিকম্পের কারণে নগরের বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। আতঙ্কে অনেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটেই। 

সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, সিলেটে ছয়বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টা ৩৬ মিনিটে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে তিন। এরপর সকাল ১০টা ৫১ মিনিটে ৪ দশমিক ১ মাত্রা, ১১টা ৩০ মিনিটে ২ দশমিক ৮ ও দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪। সর্বশেষ ভোর ৪টায় ভূমিকম্পে ফের কেঁপে ওঠে সিলেট। ভোরের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ২ দশমিক ৮।

এদিকে, ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন সিলেটে ২০১৯ সালে সার্ভে করে সিলেট নগরের ২৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সর্বশেষ শনিবার টানা ভূমিকম্পে হেলে পড়া আরও একটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় চলে আসে। এ নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় ২৪টি সরকারি-বেসরকারি ভবন রয়েছে।

রোববার বিকেলে অভিযান শেষে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, কাছাকাছি সময়ে ভূমিকম্পের কারণে সিলেট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য ভু-তত্ত্ববিদদের পরামর্শ মতে তালিকাভুক্ত সকল ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আগামী ১০ দিনের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। যদি বড় ধরনের আশঙ্কা কেটে যায় তাহলে বন্ধ কমিয়ে আনা হতে পারে।

ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় থাকা বিপনী বিতানের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা ইচ্ছে করে কারো ব্যবসার ক্ষতি করতে চাচ্ছি না। যেহেতু বড় ধরনের ভূমিকম্পের একটা আশঙ্কা রয়েছে তাই এসব মার্কেট বন্ধ করা হচ্ছে। যাতে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি না হয়। যদি বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা কেটে যায় তাহলে বন্ধ কমিয়ে আনা হতে পারে।

নগরের পাঠানটুলা এলাকায় ভূমিকম্পে হেলে পড়া বহুতল ভবন পরিদর্শন শেষে মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ভবনের মালিককে না পেয়ে তত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের ভবনের নকশা দেখাতে পারেননি। তাই আমাদের প্রকৌশলীরা ভবনটি পরিদর্শন করেছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এজন্য ভবনের বাসিন্দারাও আগামী ১০ দিন ভবনে অবস্থান করতে পারবেন না। নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। অভিযানে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস ও গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন।

ঝুঁকিপূর্ণ ২৪ ভবন 
ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেটে ২০১৯ সালে জরিপ করে নগরের ২৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সর্বশেষ শনিবার টানা ভূমিকম্পের কারণে হেলেপড়া আরো একটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় চলে আসে। 

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো হলো, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উত্তর পাশের কালেক্টরেট ভবন-৩, জেল রোডস্থ সমবায় ব্যাংক ভবন, একই এলাকায় মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজারস্থ সিটি সুপার মার্কেট, জিন্দাবাজারের মিতালী ম্যানশন, দরগাগেইটের হোটেল আজমীর, বন্দরবাজারের মধুবন সুপার মার্কেট, টিলাগড় কালাশীলের মান্নান ভিউ।

এছাড়া, নগরের শেখঘাট এলাকায় শুভেচ্ছা-২২৬ নম্বর ভবন, যতরপুরের নবপুষ্প ২৬/এ বাসা, চৌকিদেখির ৫১/৩ সরকার ভবন, জিন্দাবাজারের রাজাম্যানশন, পুরানলেনের ৪/এ কিবরিয়া লজ, খারপাড়ার মিতালী-৭৪, মির্জাজাঙ্গাল মেঘনা এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বাগবাড়ির একতা ৩৭৭/৭ ওয়ারিছ মঞ্জিল, একই এলাকার একতা ৩৭৭/৮ হোসেইন মঞ্জিল, একতা-৩৭৭/৯ শাহনাজ রিয়াজ ভিলা, বনকলাপাড়া নূরানি-১৪, ধোপাদিঘীর দক্ষিণ পাড়ের পৌর বিপনী মার্কেট ও ধোপাদিঘীরপাড়ের পৌর শপিং সেন্টার।

এর মধ্যে পুরান লেনের ৪/এ কিবরিয়া লজটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে মেরামত করা হয়েছে।

তুহিন আহমদ/এমএএস