ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের থেকেও নীরবে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা উপকূলে যখন ঘূর্ণিঝড় ইয়াস তাণ্ডব শুরু করে এর কিছুক্ষণ পরই বাংলাদেশের উপকূলে শুরু হয় ইয়াসের মূল প্রভাব। নদীর পানি বৃদ্ধি ও জলোচ্ছাস ছিল ভয়ানক। 

আম্ফানকে ঘিরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল ইয়াস মোকাবেলায় নেওয়া হয়নি তার ছিটেফোটাও। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন, ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূলে কোনো ক্ষতি হবে না। 

এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেছিলেন, বাঁধের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে বাস্তবে ইয়াসের প্রভাবে তছনছ হয়ে গেছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ও জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার শতাধিক গ্রাম। ভেসে গেছে পাঁচ হাজারের বেশি মাছের ঘের।

গতকাল বুধবার (২৬ মে) বেলা ১১টা ৪০ মিনিট থেকে সাতক্ষীরার উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের মূল প্রভাব পড়তে শুরু করে বলে জানায় সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তা মো. জুলফিকার আলী। ওই সময় আকাশে ছিল রোদ। উপকূলীয় কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া, ইছামতি নদীসহ উপকূলবর্তী নদীগুলো ছিল উত্তাল। সাড়ে ৪ ফিট উচ্চতার জলোচ্ছাস আছড়ে পড়তে শুরু করে তীরে। তখন বাতাসের গতিবেগও ছিল অনেকটা কম। ক্ষণে ক্ষণে রোদ আবার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ছিল আবহাওয়ার রুপ পরিবর্তন। 

বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম মোবাইলে জানান, ইউনিয়নের মান্নানের পাইপকল নামকস্থানে কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ভেঙে গেছে। লোকালয়ে পানি প্রবেশ শুরু করেছে। সেখানে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও নেই। মানুষদের শেষ রক্ষা হবে না। 

বাঁধ ভাঙার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, মান্নান স্থানীয় সরকার দলীয় এক রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় বাঁধের মধ্যে পাইপ বসিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায়। এ পানি স্থানীয় ঘের ব্যবসায়ীদের কাছে সে বিক্রি করে। বাঁধে ছিদ্র থাকায় আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঠিক সেখানেই ভেঙেছে বাঁধ। আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদুল হক বলেন, বাঁধে পাইপ বসিয়ে পানি ঢুকালে বাঁধ টেকসই থাকে না। আমরা জানি ওখানে বাঁধের মধ্যে পাইপ বসিয়ে পানি ঢোকানো হয়। তবে আমাদের কিছু করার নেই। আইনগত ব্যবস্থা নিতে গেলে আমরা টিকে থাকতে পারব না। 

উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার নীলডুমুর খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে এভাবে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই প্রকৌশলী। তখন জলোচ্ছাসের তাণ্ডব চলছে সাতক্ষীরার গোটা উপকূলীয় এলাকায়। বেলা ১২টা ২০ মিনিট থেকে খবর আসতে শুরু করে জেলার বিভিন্নস্থান দিয়ে বাঁধ উপচে আবার কোথাও উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ শুরু করেছে। প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে লোকালয়। এলাকার স্বেচ্ছাসেবক, বিজিবি সদস্য, কোস্টগার্ড, গ্রামবাসীরা বাঁধ রক্ষায় চেষ্টা করছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

বৃহস্পতিবার (২৭ মে) দুপুর ১টা পর্যন্ত সব শেষ খবর অনুযায়ী বেড়িবাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে কালিগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি, শ্যামনগর ও তালা উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় ভেসে গেছে ঘর-বাড়ি ও একাধিক মাছের ঘের। পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে।

শ্যামনগর উপজেলার নীলডুমুর এলাকায় নদীর তীরে পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয়। রেঞ্জ কর্মকর্তা এম এ হাসান ঢাকা পোস্টকে জানান, আজকেও (বৃহস্পতিবার) নদীতে একই অবস্থা বিরাজ করছে। নদীতে তীব্র জোয়ার। অফিসের মধ্যে পানি উঠে গেছে। নদীতে ঢেউয়ের মাত্রাও খুব বেশি রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে স্টেশন কার্যালয়গুলোর অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে পানি থাকায় ক্ষয়ক্ষতি এখনো নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। বন্যপ্রাণীর ওপর প্রভাব পড়েছে কিনা সেটিও এখনো নির্দৃষ্টভাবে জানা যায়নি। নদী শান্ত হয়ে সুন্দরবন প্রবেশ করতে পারলে তখন জানা যাবে। 

এদিকে, শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পশ্চিম পাতাখালি এলাকায় কপোতাক্ষ নদীর প্রায় ৫০ হাত বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। 

ইউনিয়নের পাতাখালি গ্রামের বাসিন্দা শাহিন বিল্লাহ্ জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে নদীর জোয়ারের চাপে পশ্চিম পাতাখালি এলাকায় কপোতাক্ষের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। বুধবার ও আজ (বৃহস্পতিবার) পশ্চিম পাতাখালি, বন্যতলা, চন্ডিপুর, চাউলখোলাসহ ৮-৯ জায়গায় কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। এসব এলাকায় হু হু করে পানি ঢুকছে লোকলয়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করে মাপ জরিপ কাজ করে গেছেন। 

গ্রামবাসীরা ভাটির সময় মাটি দিয়ে মেরামত করলেও জোয়ারের সময় সেই মাটি ধুয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ইউনিয়নের ৬-৭টি গ্রাম পুরোপুরি প্লাবিত হয়ে গেছে।

আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম বরণ চক্রবর্তী জানান, উপজেলার ১০টি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে। এর মধ্যে দুটি স্থানে মেরামত করা হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে বড়দল ইউনিয়নের বামনডাঙা স্লুইচগেট ও নড়েরাবাদ এলাকায় খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। 

বুধবার থেকে এখন পর্যন্ত উপজেলায় ২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভাঙন এলাকা দিয়ে এখন জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হবে। 

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, শ্যামনগর উপজেলাসহ আমার এলাকার মধ্যে সাতটি পয়েন্টে ২২০ মিটার উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ওই সব স্থান মেরামতের জন্য কাজ করা হচ্ছে। টাকার হিসাবে ক্ষতির পরিমাণটা আরও পরে জানা যাবে। মূলত জলোচ্ছাসের কারণে বাঁধের এই ক্ষতি হয়েছে। উপকূলে জলোচ্ছাস আঘাত হেনেছে সাড়ে ৪ ফিট উচ্চতায়।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান জানান, ইয়াসের প্রভাবে নদীর জলোচ্ছাসে আশাশুনিসহ আমার এরিয়ার মধ্যে নয়টি পয়েন্ট উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙেছে। কতটুকু ভেঙেছে আমরা সেটি নিরুপণ করছি। বিস্তারিত পরে জানাতে পারব।

অন্যদিকে, জেলায় পাঁচ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, বাঁধ ভেঙে চার উপজেলায় বর্তমান পর্যন্ত ৬৩০০ হেক্টর মাছের ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতি হয়েছে ৫৫ কোটি টাকার। মাছ চাষিরা এবার যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময়ও হয়নি।

সাতক্ষীরা জেলা দুর্যোগ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইন্দ্রজিত সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বুধবার (২৬ মে) ইয়াসের প্রভাবে জেলায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ২১টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গেছে ৫.৭ কিলোমিটার। আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল থেকে জেনেছি কয়েকটি স্থানে আরও বাঁধ ভেঙে গেছে ও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কতগুলো ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটির হিসাব এখনো আমরা পাইনি। জেলায় পুরো ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পেতে কিছুটা সময় লাগবে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র নিরুপণ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এমএএস