জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি ছিলেন প্রেমের কবি। ছিলেন সাম্য, বিরহ, বিদ্রোহের কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘রোমান্টিক বিদ্রোহী’ কবিও বলা হয় তাকে। তিনি এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী রেখে আরেক হাতে রণতূর্য রাখতে জানতেন। 

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলে জন্ম নেওয়া কাজী নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহের ত্রিশালে তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি রেখে গেছেন। আসানসোল থেকে দারোগা রফিজ উল্লাহর হাত ধরে তিনি এসেছিলেন এই ত্রিশালে। যেটা ছিল এই বাংলায় নজরুলের প্রথম আগমন। 

নজরুল একাডেমি মাঠের দক্ষিণ পাশে নির্মিত নজরুল মঞ্চ

ময়মনসিংহের ত্রিশালের বুকে রয়েছে জাতীয় কবির অন্যতম বাল্য বিদ্যাপীঠ দরিরামপুর হাই স্কুল, কাজির শিমলা দারোগা বাড়ি, নামাপাড়া এলাকার বিচ্যুতিয়া ব্যাপারী বাড়ি আর নজরুল বটবৃক্ষ। 

প্রতি বছর নজরুলের জন্মদিন এলেই তার স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানগুলো ভক্ত-অনুরাগীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। নজরুল জয়ন্তী উৎসব-আনন্দে মাতে পুরো ত্রিশাল। তবে মহামারি করোনা থামিয়ে দিয়েছে সব কিছু। নজরুলের স্মৃতিময় ত্রিশালে আজ নেই সেই প্রাণের ছোঁয়া। টানা দুই বছর ভিন্ন এক আবহে প্রিয় কবিকে স্মরণ করছে ত্রিশাল তথা ময়মনসিংহবাসী।

এই বটবৃক্ষের ছায়াতলে বসে কাজী নজরুল বাঁশি বাজাতেন আপন সুরে

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও অনসাম্বল থিয়েটারের সভাপতি আবুল মনসুর বলেন, প্রতি বছর নজরুল জয়ন্তী উৎসব তিনদিন হলেও আমরা কয়েকমাস আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু করতাম। এরপর অধীর আগ্রহে থাকতাম কখন নজরুল জয়ন্তীটা হবে। প্রত্যেকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে যেত। দেশের ১৫০-২০০টি সংগঠনের পরিবেশনা থাকেতো এই উৎসবে। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই বছর এ আয়োজনটি হচ্ছে না। তবুও এই দিনটি আসলে এখানে এসে দেখে যাই। কারণ এই জায়গাটার প্রতি আমাদের অন্যরকম ভালোলাগা বা প্রেম সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় সাংবাদিক মোস্তাফিজ নোমান বলেন, জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতিধন্য ত্রিশাল নজরুলপ্রেমী কবি, সাহিত্যিক ও ভক্তদের পদচারণায় মুখর থাকে। ত্রিশালের আপামর মানুষ এ উৎসবে নিজেদের সম্পৃক্ত করে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। আমরা যারা সংবাদপত্রে কাজ করি তারা এই আনন্দ-উল্লাস সারাদেশ ও বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ৩-৪ টি দিন ব্যস্ততায় পার করি। দুই বছর ধরে নজরুল জয়ন্তী পালিত না হওয়ায় এই উৎসব থেকে ত্রিশালের মানুষ বঞ্চিত। এই বিষয়টি আমাদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক। 

আসানসোলের একটি রুটির দোকানে কাজ করা কিশোর নজরুলের অমিত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ১৯১৪ সালে তাকে ত্রিশালে নিয়ে আসেন দারোগা রফিজ উল্লাহ। উপজেলার কাজীর শিমলা দারোগা বাড়িতে থেকে নজরুল ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন দরিরামপুর স্কুলে। সেখান থেকেই বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 

বিচ্যুতিয়া বেপারী বাড়িতে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট কবি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র

এদিকে কাজীর শিমলা থেকে স্কুলে যাতায়াতে অসুবিধার কারণে নামাপাড়া বিচ্যুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতে জায়গির থাকতেন নজরুল। এ সময় কবি প্রায়ই ছুটে যেতেন সুকনী বিলের প্রান্তরে। বিলের কাছে বটবৃক্ষের ছায়াতলে বসে বাঁশি বাজাতেন আপন সুরে। 

ত্রিশালে নজরুলের শৈশবের স্মৃতিকে ধরে রাখতে কাজির শিমলা গ্রামের দারোগা রফিজ উল্লাহর বাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে কবি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র। এখানে ঠাঁই পেয়েছে নজরুলের ব্যবহৃত আসবাবসহ তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা পর্বের আলোকচিত্র। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি পাঠাগারও। 

নামাপাড়া গ্রামের বিচ্যুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতেও নির্মিত হয়েছে কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ও আর্কাইভ। তিন তলা বিশিষ্ট এ স্মৃতিকেন্দ্রে রয়েছে ২০০ আসনের অডিটোরিয়াম ও নজরুল জাদুঘর কাম পাঠাগার। 

ত্রিশাল দরিরামপুর স্কুল তথা নজরুল একাডেমির এক পাশে তৈরি করা হয়েছে নজরুল মঞ্চ ও ডাকবাংলো। একাডেমির পাশে নতুন বেশ কিছু ভবন গড়ে উঠলেও নজরুল যেখানে পড়তেন সেই ভবনটি রাখা হয়েছে অনেকটা আগের মতই। তার শ্রেণিকক্ষের সামনে মর্মর পাথরে খোদাই করে লিখে রাখা হয়েছে কবির নিজের হাতের লেখা- ‘আমি এক পাড়াগেঁয়ে স্কুল পালান ছেলে/ তার ওপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে না/ স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আমার আজও জ্বল তেষ্টা পেয়ে যায়। ’ 

আর নজরুলের প্রিয় সুকনী বিলের প্রান্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালের ৯ মে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও সঙ্গীত বিভাগ থাকলেও এখন এখানে পাঁচটি অনুষদে বিভাগ রয়েছে ২৩টি। 

কাজির শিমলা গ্রামের দারোগা রফিজ উল্লাহর বাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র

বর্তমানে ১৯৫ জন শিক্ষক ও ১২০ জন কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। এখানে পড়াশোনা করছেন ৭ হাজার ২৩২ জন শিক্ষার্থী। প্রতিটি বিভাগে আছে ‘নজরুল স্টাডিজ’ নামে ১০০ নম্বরের একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। কবির জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণা এবং উচ্চতর শিক্ষার জন্য রয়েছে ‘ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ’। এসব কারণে এক সময়কার অজপাড়াগাঁয়ের ত্রিশাল আজ নজরুল ভক্ত ও গবেষকদের কাছে গবেষণার চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। 

জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকীতে যে জায়গাগুলো থাকে আলো ঝলমলে, গান-কবিতা-নাটকে নজরুলের স্মৃতি রোমন্থন করে সবাই, করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই জায়গাগুলো আজ থমথমে। জন্মজয়ন্তীর উৎসব আনন্দে মুখরিত ত্রিশাল আজ যেন নিষ্প্রাণ। নজরুল একাডেমির যে মাঠে থাকতো ভক্তদের উপচেপড়া ভিড় সেই মাঠ আজ শূন্য। ফাঁকা মাঠ যেন তাকিয়ে আছে অসহায়ের মত। তবে সকলের প্রত্যাশা করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই দিনে আবারো সবাই মেতে উঠবেন নজরুল জয়ন্তীর আনন্দে।

বিচ্যুতিয়া ব্যাপারী বাড়ির নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে সংরক্ষিত রয়েছে তার বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র

কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকের এই দিনে উৎসবের মধ্য দিয়ে কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী পালন করি। দর্শনার্থীদের ভিড়ে ভরপুর থাকে এই স্মৃতিকেন্দ্র। কিন্তু করোনার কারণে এমনটা এবার হচ্ছে না। এতে আমাদের মনটাও খারাপ। আমরা আশা করি পরিস্থিতি ঠিক হলে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের আবেগ কাজ করে। দুই বছর করোনার কারণে দুটি উৎসব আয়োজন করা সম্ভব হয়নি, আশা করছি আগামীতে এমন পরিস্থিতি কেটে উঠলে বড় পরিসরে আয়োজন করা সম্ভব হবে। যেহেতু সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ময়মনসিংহেরই সন্তান, সেহেতু এই ব্যাপারে তার বাড়তি নজর আমরা পাব বলে আশা করছি।

আরএআর