মাথায় ময়লায় স্তূপ। চুলে বেঁধেছে জট। হাতে রাস্তা থেকে কুড়ানো অপরিচ্ছন্ন কাগজ। মুখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে পানের পিক। এমন অবস্থায় খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ৪৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী এক নারী। এ সময় তার পিছু নেন কিছু তরুণ-তরুণী। হাঁটতে হাঁটতে ওই নারী মুজগুন্নি স্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনিতে বসেন। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যান তরুণ-তরুণীরা। তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। 

তবে মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারী স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেন না। তরুণ-তরুণীরা তার চুল কেটে দেওয়ার কথা বলেন। তবে ওই নারী প্রলাপ বকতে থাকেন। একপর্যায়ে স্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করে তরুণ-তরুণীরা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারীর ময়লায় জটবাঁধা চুল কেটে দেন। এরপর পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে নিয়ে বাড়ির গৃহকর্তীর সহযোগিতায় দুই তরুণী তাকে গোসল করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দেন। এরপর হাত-পায়ের নখ কেটে দেন তারা। খাবার পানি ও বিস্কুট খেতে দেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর স্থানীয়রা তাকে দেখতে ছুটে আসেন। ওই তরুণ-তরুণীরা তার দুপুরের খাবারেরও ব্যবস্থা করে দেন। 

সোমবার (২৪ মে) এমনই ভিন্নধর্মী মানবিক কাজের দেখা মিলল খুলনা মহানগরীর খালিশপুর মুজগুন্নী এলাকায়। 

 স্থানীয় বাসিন্দা আফসার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বছর ধরে এই পাগলিকে মুজগুন্নি ও বৈকালী মোড়ে ঘুরাফেরা করতে দেখি। সে পাগলের মতো ঘুরতো। মাথায় জট ছিল। কাগজ, কাপড়সহ ময়লা টুকাতো। আর বটতলা ও যাত্রী ছাউনিতে শুয়ে থাকতো। আজ কিছু মানুষ এসে চুল ও নখ কেটে তাকে গোসল করিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে নতুন পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। খাবারও দিয়েছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার পর এখন তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে।

শুধু ওই নারীকেই নয়, ওই বৈকালী মোড়ে ভাসমান এক বৃদ্ধকে চুল কেটে গোসল করানোর পর একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জি দেন তারা। দুপুরের খাবারের জন্য তাকে টাকাও প্রদান করা হয়।

ডুমুরিয়ার রংপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা সংগঠক সবুজ মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ সকাল ৯টায় শাহাপুর এলাকা থেকে বেরিয়ে বৈকালী মোড় পর্যন্ত দুইজন ভাসমান ও ভারসাম্যহীন মানুষকে পেয়েছি। তাদের চুল, নখ কাটা হয়েছে। গোসল করিয়ে নতুন পোশাক দিয়েছি। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। ভবিষ্যতে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা, অসহায় মানুষ যাতে ফ্রিতে খেতে পারেন সে জন্য দোকান ঠিক করার চেষ্টা করব। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন ভালো মানুষ রয়েছে। ফাদার, শিক্ষক-শিক্ষিকা, তরুণ-তরুণী, যুবক, গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন বন্ধুরা রয়েছেন। 

তিনি বলেন, ভালো কিছু করার মাঝে একটা ভালো লাগা আছে। এই ভালো লাগাটা তারাই বোঝে, যারা ভালো কিছু করে। আজ কিছু অসহায় মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে। প্রতি সপ্তাহে একদিন এই কাজ করবো। 

ফাদার প্রেমানন্দ কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলে-মেয়েরা উদ্যোগী হয়ে ভাসমান মানুষকে মাথার চুল কেটে দিয়ে গোসল করিয়ে খাবার খাওয়াবে এই কথা শুনে এসেছি। তাদের চিন্তা-চেতনা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এ জন্য তাদের সঙ্গে আছি। যে এলাকায় ছেলে-মেয়েরা এই কাজ করেছে সেই এলাকার বাসিন্দারা সহায়তা করেছেন। তাদের কাজ দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। 

শিক্ষক সুক্রিতি সরকার বলেন, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি আমরা। এই সমাজের যারা পিছিয়ে পড়া মানুষ, যাদের কেউ নেই তাদের সহযোগিতা করার জন্য এসেছি। যদিও এটুকু যথেষ্ঠ নয়। তাদের অধিকার যতদিন প্রতিষ্ঠিত না হবে, তারা ততদিন মূল স্রোতে আসবে না। সেই বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। এসব মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। 

মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তানিয়া বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ খুবই ভালো লাগছে। নিজের হাতে কিছু করার সুযোগ পেয়েছি। মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। ভবিষ্যতে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের সুস্থ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করার চিন্তা করছি। গৃহহীনদের বসবাসের জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করবো।  

সরকারি শাহাপুর মধুগ্রাম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ধ্রুব বসাক বলেন, আমরা প্রতি সপ্তাহে একদিন ভাসমান এসব মানুষের পাশে থাকতে চাই। সুন্দর পরিবেশে যাতে তারা আমাদের সঙ্গে বসবাস করতে পারে। ভবিষ্যতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে চাই।

ফুলতলা রি-ইউনিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক কনক কুমার মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনার প্রধান সড়কে যেসব ভাসমান মানুষ আছে, যাদের দেখার কেউ নেই সবাই মিলে তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দুপুরের খাবার দিয়েছি। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আশা করছি অন্যরাও এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। যাতে অসহায় মানুষগুলো কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়। 

মোহাম্মদ মিলন/আরএআর