সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ দিয়ে গতকাল রোববার পর্যন্ত (২৩ মে) গত ৫ দিনে ৬৫ জন ভারতে আটকেপড়া বাংলাদেশি দেশে ফিরেছে। 

ফেরত আসাদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জেলা পরিষদের শিবগঞ্জ উপজেলা ডাকবাংলো, জেলা শহরের হোটেল আল নাহিদ, রোজ আবাসিক হোটেলে এ ৬৫ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। 

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভারত ফেরত ৬৫ জনের মধ্যে একজনের দেহে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ভারতীয় ধরন পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফলাফল পাওয়া যায়নি। 

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় ভারত থেকে ফিরে বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইনে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে নাগরিকদের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট বা এনওসি পেতে নানা হয়রানির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশে ফিরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে গিয়ে মিলছে না পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ খাবার পানি। 

রাজশাহী কোর্ট স্টেশন এলাকার ইউসুফ আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন ভারতে। দেশে লকডাউন ঘোষণা করলে ও সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলে আটকে পড়েছিলেন নজরুল। 

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, গত ২০ মে সোনামসজিদ দিয়ে দেশে ফিরেছি। এরপরই প্রশাসন হোটেল আল নাহিদে নিয়ে আসে। এখানে জেলা প্রশাসন থেকে তিন বেলা খাবার দিয়ে যায়। কিন্তু এখানে সবসময় খাবার পানি সরবরাহ পাওয়া যায় না। এমনকী রুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রেও হোটেল কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। এখানে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছি আমরা। পানি স্বল্পতার কথা জানান শিবগঞ্জ উপজেলা ডাকবাংলো কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকা আরেক ভারত ফেরত নাগরিক।

ভারত ফেরত ব্যবসায়ী মমিনুল ইসলাম বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এনওসি পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে যাদের ব্যবসায় ভিসা রয়েছে তাদেরকে কোনোভাবেই নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট বা এনওসি দিচ্ছে না। এছাড়াও যাদের ভিসার মেয়াদ রয়েছে, তাদেরকেও বিভিন্ন হয়রানি ও ফিরিয়ে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকমিশন। 

তিনি আরও বলেন, সেখানে থাকতে থাকতে টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গিয়ে আরও বেশি বিপদে পড়তে হয়েছে অনেককেই। টাকা শেষ হয়ে নানারকম হয়রানির শিকার হয়েছি। দেশের হাইকমিশন আমাদের তেমন সহযোগিতা করেনি। 

সুয়ে, ঘুমিয়ে, টিভি দেখে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দিন কাটছে উল্লেখ করে সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ফেরত এক ২৪ বছর বয়সী এক ক্যান্সার রোগী জানান, চেন্নাই গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। গত ১৭ তারিখে কলকাতা হাইকমিশনে গিয়ে দেশে ফেরার জন্য যোগাযোগ করলে তারা এনওসি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অনেক ঘুরে ঘুরে এনওসি নিয়ে গত ২০ মে দেশে ফিরেছি। 

তিনি আরও জানান, কোয়ারেন্টাইনে সেন্টারের খাবারের মান মোটামুটি ভালো। কিন্তু পানির অপর্যাপ্ততা রয়েছে ব্যাপক। মোটা চালের ভাত দেয়া হচ্ছে। সঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না। এমনকি থাকার ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর কথা বলা হয়েছে। আমরা কৃষক, খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ। তাছাড়া আমরা যেহেতু নানা হয়রানির পরে দেশে ফিরেছি, তাই আমাদের দাবি রুমের ভাড়া মওকুফ করা হোক। ভারতে আরও প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি আটকে রয়েছে বলেও জানান তিনি। 

নিজের ব্যবসা ও শ্যালকের চিকিৎসার জন্য পরিবারের ৫ সদস্যকে নিয়ে এ মাসের শুরুর দিকে ভারতে গিয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, হঠাৎ করেই ভারতীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। তার আগে আটকেপড়া দেশের নাগরিকের সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। ঈদের আগে ফিরতে দিলে আরও ভালো হতো। ভারতে থাকাকালীন সময়ে করোনার দুটি ডোজ সম্পন্ন করেছি, সেখানকার সার্টিফিকেটও আছে। দেশে ফিরে করোনা টেস্টে নেগেটিভ এসেছে। তারপরও আমাকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। 

জেলা শহরের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হোটেল আল নাহিদের ১১টি কক্ষে রয়েছে ২৭ জন ভারত ফেরত বাংলাদেশি। এর প্রত্যেক কক্ষে ৩-৪ জন করে থাকছেন। তবে ২টি রুমে ১১ জন ব্যক্তি অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত করেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। 

হোটেল আল নাহিদের ম্যানেজার পিন্টু রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, সোমবার সাড়ে ১১টা পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের সকালের খাবার আসেনি। তাই কোয়ারেন্টাইনে থাকাদের সঙ্গে কথা বলে বাইরে থেকে খাবাবের ব্যবস্থা করেছি। রুম পরিষ্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে নিজেরাই রুম পরিষ্কার করে রুমের বাইরে থাকা ঝুড়িতে আর্বজনা রাখবে। এরপর আমাদের লোকজন গিয়ে তা নিয়ে আসবে। 

সোনামসজিদ স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন ইনচার্জ জাফর ইকবাল বলেন, ভারতীয় এনওসি'র ব্যাপারে আমাদের কোনো করণীয় নেই। যতগুলো মানুষ আসছে আমরা প্রতিদিন ততোজনকেই রিসিভ করছি। এনওসি'র ব্যাপারে সিদ্ধান্ত একান্তই কলকাতায় বাংলাদেশি হাইকমিশনের। 

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব-আল-রাব্বী জানান, সঠিকভাবেই খাবার ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরেও কোনো অসুবিধা হলে তারা (ভারত ফেরত বাংলাদেশিদের) নিজ খরচে খাবার ও পানির ব্যবস্থা করবে। 

এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের সকল নির্দেশনা মেনে ভারত ফেরতদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে কাজ করছে জেলা সিভিল সার্জন অফিস ও জেলা প্রশাসন। ১২ দিনের মাথায় সকলের পরীক্ষা করে নেগেটিভ পেলেই ছাড়পত্র মিলবে। অন্যদিকে পজিটিভ হলে আবারো ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সকলের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। 

প্রসঙ্গত, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেনাপোল বন্দরের পাশাপাশি দর্শনা, হিলি ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে আটকেপড়া বাংলাদেশিরা আসছেন। গত রোববার সকাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে নাগরিকদের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট বা এনওসি দেয়া শুরু হয়েছে। 

জাহাঙ্গীর আলম/এমএএস