নকশিকাঁথায় বদলে গেছে সেলিনার জীবন, হয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা

অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে অনেকদিন চাকরির পেছনে ছুটেছেন সেলিনা আক্তার। চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ঘরে বসেই নকশিকাঁথার ব্যবসা শুরু করেন। ৬ বছরের মধ্যেই নিজে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্তত ৫০ জন অসহায়-বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন ভোলার অদম্য এই নারী উদ্যোক্তা। পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা।
সেলিনা আক্তার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ভোলা সদর পৌরসভা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাঠালি এলাকার বেপারি বাড়ির বাসিন্দা মো. আলমের স্ত্রী। সামান্য পুঁজি দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘গ্লামার জোন নকশিকাঁথা’ নামে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, পারিবারিকভাবে বিয়ের পর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সেলিনা আক্তার। সংসার জীবনে স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে প্রথমদিকে ভালোভাবে তাদের সংসার চললেও এক সময় তার সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয়। নিজেই বেরিয়ে পড়েন চাকরির খোঁজে। কিন্তু চাকরি না পেয়ে হতাশ হন, ভাবেন চাকরি ছাড়া টাকা আয় করা যায় না। এরপর ইউটিউবে নকশিকাঁথা ডিজাইন ও সেলাই দেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন নিজেই নকশিকাঁথার ব্যবসা করবেন। বড় ভাইয়ের থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নিয়ে নেমে পড়েন ব্যবসায়। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও একাগ্রতায় নকশিকাঁথা তৈরি করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন এ নারী। ভোলায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ২০২৩ সালে পেয়েছেন ভোলা সদর উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা। বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই কাঁথা বিক্রি করছেন। চাহিদাও রয়েছে বেশ। ৩শ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা দামের নকশিকাঁথা রয়েছে তার কাছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন নারী এসেছেন তার কাছে নকশীকাঁথা ডিজাইন ও সেলাই শিখতে। আবার কেউ কেউ এসেছেন প্রতিদিনের মতো কাজ করতে। সেলিনা আক্তার নিজেই তাদের কাজ তদারকি করছেন আবার কাঁথায় ডিজাইন করছেন। বর্তমানে ব্যবসা ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ জয়িতা।
সেলিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই সেলাই ও আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল। সংসার জীবনে আমার মেয়েরা পড়াশোনা শুরু করার পর নানান কারণে সংসারের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। তখন চিন্তা করলাম আমার কিছু করার দরকার। প্রথমে মনে করেছিলাম মেয়েদের চাকরি ছাড়া টাকা উপার্জন করতে পারে না। কয়েক বছর চাকরির পেছনে ছুটেও চাকরি পেলাম না। চিন্তা করলাম চাকরি ছাড়া কিছু করা যায় কিনা। হঠাৎ একদিন ইউটিউবে দেখি নকশিকাঁথার ব্যবসা করে অনেকে আয় করছে। ২০ হাজার টাকার সুতা-কাপড় কিনে ব্যবসায় নেমে পড়লাম। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
তিনি আরও বলেন, নকশিকাঁথা বিক্রির অর্থ দিয়ে দুই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি। এক মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছি। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আমার সংসারও ভালো চলছে। এছাড়া আমার প্রতিষ্ঠানে ৫০ থেকে ৬০ জন নারী কাজ করে। তারা অনেকে নিজেরাও নিজেদের মতো ঘরে বসে কাজ করে উপার্জন করছেন। নারীদের ঘরে বসে না থেকে কিছু করার পরামর্শ এ উদ্যোক্তা।
সেলিনা আক্তারের কলেজপড়ুয়া মেয়ে ইসরাত জাহান মিম বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি আম্মুকে নকশিকাঁথার কাজে সাহায্য করি। আমি এখন ডিজাইন ও সেলাইয়ের কাজ করতে পারি। এতে আম্মুর অনেক সাহায্য হয়।
সেলিনা আক্তারের কাছে নকশিকাঁথা সেলাই শিখতে আসা ফেরদৌস বেগম বলেন, সেলিনা আপার কাছ থেকে নকশীকাঁথা সেলাইয়ের কাজ শিখতে আসছি। এখান থেকে কাজ শিখে বাড়িতে গিয়ে নিজেরাও নিজেদের মতো করে নকশিকাঁথা সেলাই করার পর বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করি।
সংসারে অভাবের তাড়নায় শ্রমিকের কাজ করতে আসা কুলসুম ও সাজেদা নামের দুই নারী বলেন, স্বামী রিকশা চালায়। সংসারে চারজন খাউইন্না। স্বামীর রোজগারে হয় না। এখানে কাজ করে যে টাকা পাই সে টাকা সংসারে ব্যয় করি। আমরা কোনো কাজ না পারলে সেলিনা আপা দেখিয়ে দেয়। আকারভেদে প্রতিটি কাঁথা থেকে ২শ থেকে ৪শ টাকা পাই। এখানে কাজ করে যে টাকা পাই এতে আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ যোগাড় হয়ে যায়। বর্তমানে আমরা অনেক ভালো আছি।
এবিষয়ে ঢাকা পোস্টকে ভোলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.ইকবাল হোসেন বলেন, সেলিনা আক্তার সফল ও সংগ্রামী নারী। তিনি তার সংগ্রামের মাধ্যমে নিজে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি ভোলার অসহায়-বিধবা নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। তার যেকোনো প্রয়োজনে আমরা তার পাশে আছি। গত বছর সেলিনা আক্তারকে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা দিয়েছি। ভোলার নারীদের সাবলম্বী করতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নানা পদক্ষেপের কথাও জানান তিনি।
খাইরুল ইসলাম/আরকে