ডিসির বাসভবনে ছেলেসহ কাঁদলেন সাংবাদিক বাবা
কুমিল্লায় গাছ ও পত্রিকা উপহার দিতে ডিসির বাসভবনে যাওয়ায় তাহসিন রাহমান নামে এক কিশোরকে আটকে রেখে তার বাবাকে খবর দিয়ে এনে ছবি তুলে রেখে এনডিসিকে দিয়ে শাসিয়েছেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আমিরুল কায়সার। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) কুমিল্লা নগরীর জেলা প্রশাসকের বাসভবনে এ ঘটনা ঘটে। দুপুরে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন তাহসিন রাহমানের বাবা কুমিল্লার সিনিয়র সাংবাদিক মোবারক হোসেন।
বিজ্ঞাপন
ভুক্তভোগী সাংবাদিক মোবারক হোসেন কুমিল্লার সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি সাপ্তাহিক গোমেতি সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তাহসিন রাহমান তার ছেলে। রাতে ওই পোস্টের বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন সাংবাদিক মোবারক হোসেন।
ফেসবুক পোস্টে সাংবাদিক মোবারক হোসেন লিখেছেন-
‘জনাব জেলা প্রশাসক, কুমিল্লা
সন্তানের অপরাধে ক্ষমা চাই।
তাহসিন রাহমান। আমার প্রিয় সন্তান। সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। শৈশব থেকে আমার গাছের সাথে প্রেম। প্রচারণা তেমন নেই। তবে গত কয়েক বছর যাবত এ কার্যক্রমটিকে সম্প্রসারিত করেছি। ২০০২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইনকিলাবের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তার আগে স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করেছি। এক যুগ যাবত সাপ্তাহিক গোমেতি সংবাদ পত্রিকাটি প্রকাশ করছি। সে পত্রিকা থেকে সবজি বীজ, চারা বিতরণ করছি। অনেকটা শখ। আবার সওয়াবের আশায়ও।
তা দেখে তাহসিনও আমার সহযোগী হয়ে ওঠে। পত্রিকার কাজে সহযোগিতা করে। সম্প্রতি চোখে স্ট্রোকজনিত সমস্যার কারণে আরও বেশি সহযোগিতা করছে। আর নিজেই গাছ বিতরণ করে। কখনো কখনো বিক্রি করে, গাছ ফ্রিও দেয়। সে আমার অসুস্থতার সময় গাছ বিক্রির ২ হাজার ৮০০ টাকা ব্যাংক ভেঙে আমাকে সহায়তা করে। আমার পত্রিকাটি বিলির দায়িত্ব সে নিয়েছে। প্রতি সোমবার ফজর নামাজ পড়েই পত্রিকা প্রেস থেকে আনা, ভাঁজ করা আর বিলি করা তার রুটিন হয়ে গেছে। আর বিকেলে ছাদে গাছ লাগানো, বীজতলা তৈরি করে সেখান থেকে চারা উৎপাদন। কখনো টাকায়, কখনো বিনামূল্যে বিতরণ করে। এছাড়াও সে কুমিল্লা স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলার সাথে জড়িত, স্কাউটের সদস্য। প্রশাসনে পত্রিকা বিলিটা সে নিজেই করে। গত ৫ মাস যাবত আপনার বাসভবন এবং দপ্তরে সেই পত্রিকা বিলি করেছে। সেখান থেকে হয়তো তার ইচ্ছে জাগলো আপনাকে একটি ইনডোর প্ল্যান্ট উপহার দেবে। আমাকে বলেছিল। আমি বলেছি তুমি পারবে কি না? সে দুদিন গিয়েছিল। আপনাকে পায়নি। পত্রিকা দিয়ে চলে এসেছে। আজ সকালে সে পত্রিকা এবং গাছ নিয়ে গিয়েছিল। সে আপনার বাসভবনে কীভাবে যে প্রবেশ করে ফেলেছে। হঠাৎ আমার নম্বরে ফোন। বাবা তুমি জেলা প্রশাসক মহোয়ের বাসভবনে এসো। আমি ভাবলাম কি না কি। অন্য একজন ফোন নিয়ে বলল, সে কি আপনার সন্তান, আসতে হবে। আমি দ্রুত গেলাম। সেখানে গিয়ে প্রবেশ করে তাহসিনের চোখে অশ্রু দেখলাম। ভাবতে থাকলাম কি হলো। সেখানে অবস্থানরত সবাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। শুধু কাঁদছে।
আমিও অশ্রুসিক্ত হলাম। জানতে পারলাম আমার ছেলে অপরাধ করেছে, না বলে প্রবেশ করেছে। আপনি ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করেছেন। এরই মধ্যে আমাকে ফোন ধরিয়ে দেওয়া হলো। এনডিসি মহোদয় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেন পাঠালেন? আমি বার বার প্রতি উত্তর না দিয়ে সরি বললাম, কয়েকবার বললাম। আমার পরিচয় জানতে চাইলো। আমি জানালাম। তারপর সেখানে কর্মকর্তারা আমার নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর লিখে রাখলেন। আমার সন্তানের চোখে আরও পানি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি। কী হয়েছে। তবে আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। নিশ্চয় সে বড় কোনো অপরাধ করেছে। সেই সাথে আমিও। তারপর আমি বললাম, আমার করণীয় কী। বলল, কিছু মনে করবেন না। স্যার আপনাদের ছবি তুলে রাখতে বলেছে। আমি সহাস্যে রাজি হলাম। চোখে অশ্রু, মনে হলো বাপ ছেলে বড় অপরাধ করেছি। হয়তো এটি একটি বড় পত্রিকার শিরোনাম হতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আমার করণীয় কি। আমি কি স্যারের সাথে দেখা করবো? বলল, না প্রয়োজন নেই। সবাই মিলে আমার সন্তানকে শান্তনা দিল। কর্মচারীদের কথায় আমি মুগ্ধ হলাম। কিন্তু বাপ ছেলের অশ্রু বন্ধ হয়নি। মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়, আমরা হয়তো অপরাধ করেছি। ছবিও তুলে রেখেছেন, সে ছবির সাজাও হয়তো পাবো। তবে আমি বলব, যে সন্তানের অপরাধইতো আমার অপরাধ। আমি নৈতিক শিক্ষা দিতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। আবারও বলছি আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। (লেখাটি নিজের অপরাধবোধ এবং আবেগ থেকে)’
সাংবাদিক মোবারক হোসেনের ওই ফেসবুক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ভুক্তভোগী তাহসিন রাহমানের বাবা মোবারক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেসবুকে যা পোস্ট করেছি তার প্রতিটি শব্দ সত্য। আমার ছেলে গাছ এবং পত্রিকা উপহার দিতে গিয়েছিল। ডিসি সাহেব এনডিসিকে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে দুজনের ছবি তুলে রেখে আমাদের দুজনকে শাসিয়েছেন। আমার ছেলের অপরাধটা কী ছিল জানি না।
কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী এনামুল হক ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচার-ব্যবহার সরকারি যে নীতিমালা রয়েছে সে অনুযায়ী হওয়া উচিত। আশা করছি রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত সবাই শালীনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন।
এ বিষয়ে কুমিল্লার নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) ফরিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল। বিষয়টি সমাধান হয়েছে। সাংবাদিক মোবারক ভাই আমাদের অফিসেই আছেন।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সারকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরিফ আজগর/আরএআর