খায়রুন সুন্দরী চলচ্চিত্রের পোস্টার

দেশের একটি আলোচিত ঘটনাকে নিয়ে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। সিনেমার নাম খায়রুন সুন্দরী। এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে গ্রামীণ গৃহবধূ খায়রুন সুন্দরীকে তার স্বামী ফজলুল হক পারিবারিক কলহের জেরে গলায় কলসি বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করেন। বাস্তবে তা ঠিক নয়। দুর্ঘটনাজনিত কারণে গৃহবধূ খায়রুনের মৃত্যু হয়েছিল।

৫৩ বছর পর সেই ঘটনার সত্যতা উন্মোচিত হয়েছে। মরহুম খায়রুনের বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল ইসলাম (৭২) ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার পূর্বপুরুষদের সামাজিভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও তাদের প্রতি জনমনে ঘৃণার জন্ম দিতেই তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর, জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে জামালপুর-১ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি মরহুম দেলোয়ার হোসাইন সম্পর্কিত এক সাক্ষাৎকারে রোববার (২৩ মে) তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, তারা পাকিস্তান পিরিয়ড থেকেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মানুষ। তার দাদা মরহুম আইজউদ্দিন ছিলেন মুসলিম লীগবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের সৈনিক। সেই সময়ে তিনি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানার বড়খাল গ্রামের সাড়ে ৩শ বিঘা জমির মালিক। এছাড়া তিনি দেওয়াগঞ্জ বাজারের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।

ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মৌসুমী

খায়রুল ইসলাম বলেন, হারুন বিড়ি নামে একটি কারখানাও ছিল তাদের। তার দাদার ছিল দুই ছেলে। একজন ফজলুল হক অন্যজন দেলোয়ার হোসাইন। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর যখন আইয়ূব খান ও ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন হয়েছিল, সে নির্বাচনে তার বাবা ফজলুল হক ছিলেন পাকিস্তান সম্মিলিত বিরোধী দলের দেওয়ানগঞ্জ থানার আহ্বায়ক।

তিনি আরও বলেন, এই রাজনৈতিক কারণেই তৎকালীন দেওয়ানগঞ্জের জনৈক প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতার সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব ছিল। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে প্রতিহিংসায় রূপান্তর করতেই তার মা খায়রুন বেগমের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে হত্যা হিসেবে প্রচার করতেই কাল্পনিক রং লাগানো হয়।

দেওয়ানগঞ্জ পৌর এলাকার আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম (৭৫) বলেন, তখন ফজলুল হক বড় ব্যবসায়ী। তাদের অন্য ব্যবসার ন্যায় ছিল বিড়ির ব্যবসাও। ওই সময়ে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে দেওয়ানগঞ্জের বড়খাল গ্রামের আইজউদ্দিনের বড় ছেলে ফজলুল হক বিয়ে করেন বকশীগঞ্জের মেরুরচর গ্রামের আজগর আলীর মেয়ে খায়রুনকে।

ফজলুল হকের বাড়ি

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম আরও বলেন, খায়রুন দেখতে ছিলেন খুব সুন্দরী। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। বৈবাহিক জীবনে তাদের ৫ ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। মেয়েটি শৈশবেই মারা যায়। বেঁচে থাকে ৫ ছেলে। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে দাম্পত্য কলহের জেরে হাতাহাতির একপর্যায়ে খায়রুন মারা যান।

তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জামালপুর আদালতে মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে মামলা করেন খায়রুনের বাবা আজগর আলী মাস্টার। মামলায় ফজল হক নির্দোষ প্রমাণিত হয়। এর দু-এক বছর পর ফজলুল হক সখিনা নামের একজনকে বিয়ে করেন। এদিকেও তার আরও চার ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

মরহুম খায়রুনের ছোট ছেলে ফখরুল ইসলাম (৬০) বলেন, ১৯৬৮ সালের ৩০ জুন তার মা মারা গেছেন। তিনি চাচিদের কাছে শুনেছেন, ‌‘তার মা শুধু দেখতে সুন্দর ছিলেন না, মন মানসিকতাও ছিল উদার। তিনি মানুষের উপকার করতেন।’ বাবা ফজলুল হক ২০০২ সালে হজের উদ্দেশে মক্কায় যাওয়ার পর সেখানেই তিনি মারা যান।

ফজলুল হক দ্বিতীয় স্ত্রী সখিনা হক (৭৫) স্বামীর শেষ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, তার স্বামী হজ্জে যাওয়ার প্রাক্কালে তাকে নসিহত করে গিয়েছিলন যে, হজে যাওয়ার পর যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে যেন তাকে সেখাই সমাহিত করা হয়। সেজন্য তার মৃত্যুর পর লাশ আর দেশে আনা হয়নি।

আলোড়িত এই ঘটনার বিখ্যাত দুই পাত্র-পাত্রী পৃথিবী থেকে চলে গেলেও রয়ে গেছেন দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের মনের মণিকোঠায়। মরেও তারা রয়েছেন অমর। 

এমএসআর