ফায়ার ফাইটার নয়নের মরদেহের অপেক্ষায় স্বজনরা
একমাত্র ছেলে সোয়ানুর জামান নয়নের (২৪) মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা নার্গিস বেগম। সন্তান বিয়োগের ব্যথা সইতে না পেরে নিজের বুক চাপড়ে করছেন আহাজারি। অন্যদিকে বাড়ির অদূরে প্রস্তুত করা হয়েছে কবর। উঠানে প্রস্তুত সাদা কাপড়, বাঁশ, খাটিয়া। এখন শুধু নয়নের নিথর দেহের অপেক্ষা। আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ।
বাড়ির উঠানে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত উচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নার্গিস বেগম বলছিলেন, ‘মাইনসের জান (মানুষের জীবন) বাঁচপার যায়্যা (বাঁচাতে গিয়ে) মোর যাদু হারে গেল। বাবা, নয়ন তুই হামাক ছাড়ি গেলু কেন। তোক যে কছনু এগলা চাকরি করি দূরোত থাকার দরকার নাই। তুই যে কছলু খুব তাড়াতাড়ি হামার এত্তি আসি চাকরি করবু। তুই মোক একেবারে ছাড়ি গেল, মুই কি নিয়া বাঁচিম। কায় থাকবে তোর বাড়িত।’
বিজ্ঞাপন
ঢাকায় সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হন ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপুনিয়া গ্রামে। তিনি কৃষক আখতারুজ্জামানের ছেলে। ছোটবেলা থেকে পুলিশ বা কোনো বাহিনীতে কাজ করার স্বপ্ন ছিল। ২০২২ সালে সেই স্বপ্ন পূরণে যোগদান করেন ফায়ার সার্ভিসে।
নয়ন ২০১৬ সালে ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৮ সালে ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ওই কলেজেই ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। এরপর ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন। নয়নের মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশনে। দক্ষ ও সাহসী ফায়ার ফাইটার হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যে সবার কাছে পরিচিত হওয়ায় সেখান থেকে তাকে ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকেলে গ্রামের বাড়িতে দেখা যায়, নয়নের মরদেহ দাফনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ঢাকা থেকে গ্রামে মরদেহ আসলেই জানাজা শেষে দাফন করতে প্রস্তুত আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ তার বন্ধুবান্ধবরাও।
এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা নার্গিস বেগম। বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন বাবা আখতারুজ্জামান।
নিহতের স্বজনরা বলছেন, নয়নই ছিল পরিবারের ভরসা। তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখতেন তার মা-বাবা ও বোন। কিন্তু হঠাৎ তার এমন মৃত্যুতে যেন পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেল। এমন মৃত্যু তারা মেনে নিতে পারছেন না। আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সড়কে ব্যারিকেড না দেওয়ায় সেই সড়ক দিয়ে ট্রাক ঢুকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ নিহতের স্বজনদের। ট্রাকচালককে গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি অসহায় নয়নের পরিবারের পাশে যেন সরকার দাঁড়ায় সে দাবিও জানান তারা।
আরও পড়ুন
নয়নের মরদেহ আনতে ঢাকায় পৌঁছেছেন স্বজনরা। রাতে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পৌঁছানোর কথা রয়েছে। পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা তাকে শেষবারের মতো দেখতে অপেক্ষা করছেন। নয়নের মৃত্যুর খবরে দূর-দূরন্ত থেকে স্বজনরা এসে ভিড় করছেন বাড়িতে। উঠানজুড়ে স্বজন প্রতিবেশীর আহাজারি আর কান্নার আওয়াজে পুরো এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
নয়নের দুলাভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, সচিবালয়ের মতো একটা জায়গায় আগুন লেগেছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত। এ সময় রাস্তা বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু কীভাবে সেখানে ট্রাক ঢুকে পড়ে চাপা দিয়ে মানুষ মারে? এটা ভাবার বিষয়? আমরা চাই আমার ভাইকে কেন, কারা কোন উদ্দেশ্যে মারল তার সঠিক বিচার হোক।
প্রতিবেশী সাফিউল ইসলাম বলেন, নয়ন খুব নম্র ভদ্র ছেলে ছিল। ওর বাবার যা সম্পদ আছে তা দিয়ে গ্রামে কিছু করে ভালো দিন যেত। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন লক্ষ্য ছিল মহৎ। সে ছোট থেকেই মানুষের সেবায় বাহিনীতে চাকরি করেত চাইত। ফায়ার সার্ভিসে চাকরি পায় সে। কিন্তু ঘাতক ট্রাক তাকে পিষে মারল। এটা খুব দুঃখের। তার পরিবার এখন অসহায়।
নয়নের বড় বোন সীমা আকতার বলেন, ফজরের আজানের সময় খবর আসে আমার ভাই সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তার কিছুক্ষণ পর জানতে পারি নয়ন বেঁচে নেই। আমার ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। একটা দুর্ঘটনায় আমাদের সব স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। এর দায় কে নেবে, কার কাছে বিচার চাইব? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো ওই সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে নিরাপত্তা দিতে পারেনি, এটার ব্যর্থতা কার?
নিহত নয়নের বাবা আখতারুজ্জামান জানান, নয়নের অনেক স্বপ্ন ছিল এই চাকরিকে ঘিরে। চাকরির পাশাপাশি প্রোমোশনের জন্য পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছিল। ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এই বছর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। এখন ছেলে আমার ফল প্রত্যাশী ছিল।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে সোয়ানুর জামান নয়নের মরদেহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বঙ্গবাজার সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মরহুমের জানাজায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকসহ বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে যখন আগুন লাগে। প্রায় সোয়া ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৯ ইউনিট।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর