সারি সারি চুলা জ্বলছে। হাঁড়িতে বুদবুদ শব্দ। তৈরি হচ্ছে ভাপা পিঠা। গরম কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে তেল পিঠা। হরেক রকম পিঠা-পুলি তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। শীতের এ মৌসুমে গ্রামীণ পরিবেশের আদলে সাজানো হয়েছে চারপাশ। মাঠে নজর কাড়ছে বাঁশের তৈরি কুলা-চাইলোন, ডালি-খাঁচা, ঝাঁপি, মাছ শিকারের দারকি-কলাই, কলাগাছে তৈরি সেলফি পয়েন্ট।

শীতের এ মৌসুমে ইটপাথরের দালানকোঠায় ঘেরা রংপুর শহরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দেখা মিলছে প্রতিদিন। এই বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয়বারের মতো উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি (ডব্লিউডিসিএ) আয়োজন করেছে স্বাবলম্বী পিঠা মেলা। আরিফা জাহান বীথি এই একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রশিক্ষক।

বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে চোখে পড়ে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। ফুটপাতে বসে পিঠা বিক্রি করেন এমন অস্বচ্ছল ৩২ জন নারী এ মেলায় অংশ নিয়েছেন। সেখানকার ২১টি স্টলে রয়েছে পিঠা পুলির সম্ভার। সন্ধ্যার পর বাহারি আলোকসজ্জায় সজ্জিত এ মেলায় দর্শনার্থীসহ পিঠা প্রেমীদের উপচে পড়া ভিড় দেখার মতো। 

মাঠের মাঝখানে কথা হয় পিঠা বিক্রেতা শাহানাজ বেগমের সাথে। পিঠা বানাতে মধ্যবয়সী এ নারী জানালেন, আগে তিনি ফুটপাতে বসে পিঠা বিক্রি করতেন। গত বছরের মতো এবারো উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমির এ মেলায় অংশ নিয়েছেন। মেলায় তিনি দুই ধরনের পিঠা তৈরি করছেন। একটি ঝিনুক পিঠা, অপরটি গোলাপ পিঠা। প্রতি পিস পিঠার দাম নিচ্ছেন ১৫ ও ২০ টাকা। 

তার পাশেই সেমাই পিঠা ও দুধকুলি পিঠা তৈরি করছেন বিলকিস বেগম। প্রতি প্লেট ৫০ টাকা নেয়া হচ্ছে। রুবিনা বেগম নামে আরেকজন জানালেন, তিনি ডিম পিঠাসহ কয়েক রকমের পিঠা তৈরি করছেন। তার প্রতি পিঠার মূল্য ২০ টাকা। 

শাহানাজ-বিলকিস-রুবিনার মতো আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও ফুটপাতে পিঠা বিক্রি সংসার চালানো ৩২ জন নারী এই মেলায় অংশ নিয়েছেন। তাদের কাউকে এর জন্য গুনতে হয়নি একটি টাকাও। আয়োজক সংগঠন থেকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে পিঠা বানানোর সরঞ্জাম। শুধু তাই নয়, ডব্লিউডিসিএ আয়োজিত এ পিঠা মেলা থেকে যা আয় হবে সেটাও পাবেন অংশগ্রহণকারীরা।

মেলায় ঘুরতে আসা সাব্বির আরিফ, আবেদুল হাফিজ, মমিনুল ইসলাম ও ইমরোজ ইমু জানান, গতবারের চেয়ে এবার মেলায় দর্শনার্থী বেশি। মেলার স্টলগুলোর সাজসজ্জাও ভালো হয়েছে। স্টলগুলোতে ২৫ রকমের বাহারি পিঠার সমাহার তাদের নজর কেড়েছে। নারীদের ‘রোজগারের পথ’ দেখানো এ মেলার উদ্দেশ্য হওয়ায় খুশি তারা।

গত সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেল থেকে শুরু হয়েছে এ মেলা, শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর। প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মেলার স্টল খোলা থাকছে। প্রতিদিন প্রায় এক লাখ টাকার পিঠা-পুলি বিক্রি হচ্ছে সেখানে। মেলা শেষে পিঠা তৈরির উপকরণসহ পিঠা বিক্রি থেকে লাভের টাকা অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হবে।

আয়োজক সংগঠন উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রশিক্ষক আরিফা জাহান বীথি বলেন, শহরে পরিবেশে গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে অনুভব সঙ্গে বাঙালি ঐতিহ্যের শীতকালীন পিঠার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের পরিচিতি ঘটাতে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এখানে অংশ নেয়া প্রত্যেক মা-বোন সংগ্রামী এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল। কিন্তু তারা  কনকনে শীতের মধ্যেও ফুটপাতে বসে পিঠা বিক্রি করে থাকেন। শুধুমাত্র সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে তারা অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা ফুটপাতে বসে পিঠা তৈরি করেন এমন মা-বোনদের মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। যারা মেলায় অংশ নিয়েছেন তাদেরকে সব দিক থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এ মেলায় যা আয় হবে তাও তারাই পাবেন ।

তিনি আরও বলেন, মেলায় অংশ নেওয়া ৩২ জনের মধ্যে ১৬ নারীকে স্বাবলম্বী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে। উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি বিভিন্ন ভাবে সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে স্বাবলম্বী পিঠা মেলা (সিজন-২) আয়োজন করা হয়েছে। নারীদের আয়ের পথ তৈরি করে দিতেই এই উদ্যোগ। মেলার মাধ্যমে মূলত তাদেরকে কর্মজীবনের নতুন পথচলা শুরু করতে উৎসাহ এবং সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে