কক্সবাজারে পর্যটকের ভিড় বাড়লেই হোটেল-মোটেলে শুরু হয় ‘গলাকাটা’ বাণিজ্য। কে কত বেশি টাকা হাতিয়ে নিতে পারে শুরু হয় সেই প্রতিযোগিতা। এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও যেন দেখার কেউ নেই। হোটেল ভাড়া নিয়ে কোনো তালিকা না থাকায় অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এতে করে কক্সবাজার পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার থেকে রোববার (২২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, হোটেল-মোটেলে নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট রাখার নিয়ম থাকলেও কোনো হোটেলেই তা নেই। হোটেল লজ, গ্যালাক্সি, বিচওয়ে, বিচ রিসোর্ট, হোয়াইট অর্কিডসহ বেশ কয়েকটি হোটেলে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো রুম খালি নেই। আর এসব হোটেলে প্রতিটি রুম (নরমাল) সাড়ে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকায় ভাড়া ধরা হয়েছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ রুম নেই বললেও দালালের মাধ্যমে রুম পাওয়া যাচ্ছে। 

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও হোটেল মালিকদের সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে পর্যটকের রাত যাপনের জন্য হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউজ ও কটেজ আছে পাচঁ শতাধিক। যেগুলোর দৈনিক ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ২৮ হাজার জন। ১৬ ডিসেম্বর থেকে আজ ২২ তারিখ পর্যন্ত ৭ দিনে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে এসেছেন প্রায় ৫ লাখ পর্যটক। পর্যটকরা থাকা-খাওয়া, যাতায়াত এবং কেনাকাটার বিপরীতে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যবসা হয়েছে। 

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজারে পর্যটক ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১ লাখ। সপ্তাহিক ছুটির দিন ও বিশেষ দিবসে কক্সবাজারে পর্যটকের চাপ বাড়ে। পর্যাপ্ত রুম থাকার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সিন্ডিকেটগুলো হোটেল রুমের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটরা হয়রানির শিকার হন।

যেভাবেই হোটেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়

কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটদের কাছে মূল আকর্ষণ হলো সৈকতের কাছাকাছি হোটেল থাকা। এই কারণে আড়ালে থেকেই যায় সুগন্ধা পয়েন্ট, লাইট হাউস, মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভেতরে থাকা হোটেলগুলো। পর্যটকরা সৈকতের কাছাকাছি ও সড়কের পাশে থাকা হোটেলে গিয়ে রুম খুঁজেন। এই সুযোগকে কাজে লাগায় সিন্ডিকেটগুলো। অটোরিকশা চালকদের দালাল হিসাবে নিয়োগ করে হোটেলের কক্ষের দাম দুই গুণ বাড়ানো হয়। তখন দুই হাজার টাকার রুম হয়ে যায় দশ হাজার টাকা। 

তিনি আরও বলেন, ১৬ ডিসেম্বর থেকে আজ ২২ তারিখ পর্যন্ত ৭ দিনে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে এসেছেন প্রায় ৫ লাখ পর্যটক। পর্যটকরা থাকা-খাওয়া, যাতায়াত এবং কেনাকাটার বিপরীতে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যবসা হয়েছে। 

কক্সবাজার হোটেল-মোটেলের ভাড়া নির্ধারিত আছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কক্সবাজারে হোটেল ভাড়া নিয়ে কোনো তালিকা নেই। তালিকা না থাকায় অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমরা শুরু থেকে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি করে আসছি কক্সবাজার হোটেলগুলোর ভাড়া নির্ধারিত করতে কিন্তু সেটি এখনো করা হয়নি।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, সাপ্তাহিক ছুটি ও বিশেষ দিনের ছুটিতে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউসগুলোতে চাপ থাকে। এবারের শীতের মৌসুমের শুরুতে পর্যটকের চাপ ছিল। কিন্তু আমাদের অনেক হোটেলে রুম খালি ছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়েছে কক্সবাজার হোটেল রুম খালি নেই। প্রকৃত অর্থে আমাদের অনেক রুম ফাঁকা ছিল।কিছু অসাধু চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হোটেলের দাম অতিরিক্ত নিচ্ছে। 

কক্সবাজার আগত পর্যটকরা যা বলছেন

ঢাকা থেকে আগত পর্যটক মির হোসেন বলেন, রোববার সকালে বাস থেকে নেমেছি। অনেক হোটেলে গিয়ে রুম চাইলেও রুম পাচ্ছি না। একজন অটোরিকশাচালক কলাতলী হোয়াইট বিচ নামক একটি হোটেলে নিয়ে গেলে দুই বেডের একটি রুমের দাম চাওয়া হয় ৯ হাজার টাকা। একদিন থাকব বললে পরে হোটেলের একজন বলেন, রুম খালি নেই। 

সাগর নামে আরেক পর্যটক বলেন, পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছি। নভেম্বর মাসে কলাতলীতে অবস্থিত হোটেল ওয়ার্ড বিচে থেকে ছিলাম প্রতি রাত ২ হাজার টাকায়। সেই রুমের দাম এখন ৭ হাজার টাকা চাই। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারে কেউ বেড়াতে আসবে না। 

বোরহান নামে আরেক পর্যটক বলেন, আমরা ৩ বন্ধু মিলে কক্সবাজারে এসেছি। ভালো হোটেল না পেয়ে একটি কটেজে উঠেছি। রুমও তেমন ভালো না। কিন্তু প্রতি রাতের জন্য ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে। 

খালেক নামে এক অটোরিকশা চালকের সাথে সুগন্ধা পয়েন্টের মোড়ে দেখা হয়। প্রতিবেদক হোটেল-মোটেল জোনে রুম খুঁজলেও রুম পাইনি।অটোরিকশা চালক খালেকের মাধ্যমে রুম চাইলে বিচ রিসোর্ট নামক হোটেল রুম পাওয়া যায়। যেখানে এসি ছাড়া রুমের দাম চাওয়া হয় ৫হাজার। এসিসহ ৮হাজার টাকা। 

জানতে চাইলে খালেক বলেন, হোটেল একটি রুম দিতে পারলে কমিশন হিসাবে ৫শ টাকা শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত পাই। পর্যটকদের কাছ থেকে যত বেশি রুম ভাড়া নিয়ে দিতে পারি তত বেশি কমিশন। আপনার কয়টি রুম লাগবে বলেন। আমাদের সঙ্গে সব হোটেলের ভালো সম্পর্ক। 

অতিরিক্ত রুম ভাড়া নিয়ে প্রশাসন যা বলছে

কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের পর্যটক সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর হোসাইন বলেন, কয়েকদিনে কক্সবাজারে লাখো পর্যটক এসেছে। এই সুযোগে কিছু অসাধু হোটেল ব্যবসায়ী অতিরিক্ত রুমের দাম আদায় করেছে। এমন অভিযোগে পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি হোটেলে আমরা অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছি। অভিযোগ পাওয়ার পরই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। 

কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নেজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মৌসুমির শুরুতে আমরা হোটেলে মালিকদের সঙ্গে বসেছিলাম। তারা আমাদের কথা দিয়েছিল কৃত্রিম সংকট তৈরি না করে হোটেল ভাড়া অতিরিক্ত আদায় করবে না। কিন্তু আমাদের কাছে কয়েকদিনে অনেক অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছি। আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে।

যা বলছে কক্সবাজার সচেতন মহল

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, পর্যটন মৌসুম শুরু হলে আবাসিক হোটেল রেস্তোরাঁগুলো নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়ার আশায় কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি রুমের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে পর্যটকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে গলাকাটা বাণিজ্য করা। আপনি যখন খোঁজ নিয়ে কাস্টমস ভ্যাট অফিসে গিয়ে দেখবেন হোটেল মালিকগুলো কিভাবে ভ্যাট ফাঁকি দেয়। যেভাবে রুমের সংকট দেখানো হয় সেভাবে যদি ভ্যাট আদায় করা যেত তাহলে কক্সবাজারের রাজস্ব দিয়ে কক্সবাজার জেলার উন্নয়ন করা সম্ভব হত। প্রশাসনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত এবং যারা সংকট সৃষ্টি করে গলাকাটা বাণিজ্য করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এভাবে দায়সারাভাবে চললে কক্সবাজারে পর্যটকবিমুখ হবে অচিরেই।

আরকে