সড়ক বিভাজন, স্টেশন, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণসহ বেশ কিছু কাজ বাকি রেখেই বহুল আলোচিত বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উদ্বোধনে যাচ্ছে সরকার। প্রকল্প শুরুর প্রায় এক যুগ পর ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটিসির ১০টি বাস দিয়ে যাত্রা শুরু করবে।

কাজ পুরোপুরি শেষ না করেই গত সপ্তাহে পরীক্ষামূলক দুটি বাস চালু করা হলে ভোগান্তি ও বিভ্রান্তিতে পড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন যাত্রীরা। এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হলেও কিছু সমস্যা থেকে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি কমাতে এবং সময় বাঁচানোর নামে বিআরটি প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও দেশের সব প্রকল্পের চেয়ে বেশি সময় খাচ্ছে বিআরটি প্রকল্প।

সরেজমিনে ঘুরে প্রকল্পের বিভিন্ন পয়েন্টে ধীর গতিতে কাজ চলমান দেখা গেছে।   গত ৭ ডিসেম্বর দুপুরে প্রকল্প পরিদর্শন শেষে গাজীপুর মহানগরীর শিববাড়ি বিআরটি স্টেশনে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক উদ্বোধনের বিষয়টি জানান। ওইদিন তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৯৮ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ বাস চলাচলের মধ্যেও চলমান থাকবে। আশা করছি, আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্প পুরোপুরি ফাংশনাল করা সম্ভব হবে।

এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৯৮ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, আশা করছি, আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্প পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হবে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। আর এক দিনের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। এখনো স্টেশনের নির্মাণকাজ বাকি, সড়কের বিভিন্ন স্থানে সড়ক বিভাজন তৈরি করা হয়নি। 

বিশেষ করে প্রকল্পের দুই পাশে বহু শিল্পকারখানায় লাখো মানুষ কাজ করে। সড়কের লেনগুলোতে ফেনাসিং (বেড়া) না থাকায় তারা সড়ক পাড় হতে দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় জনবল না থাকায় নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। বিশেষ করে জিএমপির জনবলের স্বল্পতা থাকায় ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে ঘাটতি হয়ে যানজটেরও আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

এই প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণা প্রচলন রয়েছে। প্রকল্পের শুরু থেকে যে ধরনের সেবা ও বাস দেওয়ার কথা প্রথম থেকে আলোচনায় ছিল, সেটিও এই মুহূর্তে দিচ্ছে না বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এ অবস্থায় সেবাটি চালু করলে মানুষের মধ্যে শুরুতেই জন্মানো নেতিবাচক ধারণাটি আরও দৃঢ় হবে।

গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকার ওবায়দুল হক বলেন, আমরা তো অনেক আশা করে আছি ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা মেট্রোরেলের মতো ভালো একটা কিছু হবে। কিন্তু এক যুগ ধরে আমরা বিআরটি প্রকল্পের কারণে দুর্ভোগের মধ্যেই আছি। উদ্বোধন হলেও এর সুফল পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

বিআরটি প্রকল্পে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেকে বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। এরপর কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেটিও হয়নি। সবশেষ বলা হয়েছিল, চলতি বছরের আগস্টে কাজ শেষ হবে। পরে সরকার আবার ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা জানায়। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিআরটি প্রকল্পে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। ফলে প্রকল্পের উদ্বোধন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল।

বিআরটি প্রকল্পে বলা হয়েছিল, বিআরটি বাস্তবায়িত হলে ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে।

যদিও তার সঙ্গে একমত না স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, বিআরটির বাস নির্বিঘ্নে চললেও পাশের দুই লেনে যানজট বাড়বে, জলাবদ্ধতা দেখা দেবে, পথচারীদের হাঁটার ফুটপাত সংকুচিত হওয়ায় তারা সড়কে চলতে বাধ্য হবে, এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের শিববাড়ি থেকে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, একটি স্টেশনের কাজও শেষ হয়নি। অনেক জায়গায় ফুটওভার ব্রিজের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। কোনো স্টেশনে এক্সেলেটর ও লিফট লাগানো হয়নি। সড়কের মাঝের বিআরটির জন্য নির্ধারিত লেনটি আলাদা করার জন্য লোহার রেলিং ব্যবহার দু-একটি স্থানে অল্প জায়গায় করা হলেও বেশির ভাগই সম্পন্ন হয়নি। সড়কের বিভাজন শেষ না হলে মানুষ যেখানে-সেখানে সড়ক অতিক্রম করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি উড়াল সড়কের কাজও বাকি রয়েছে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মো. ইব্রাহিম খান বলেন, বিআরটি প্রকল্পে বিআরটির নির্ধারিত ১৮৭টি বাস চলাচল করবে। এখন পরীক্ষামূলকভাবে দুটি বাস চলছে। উদ্বোধনের দিন থেকে বিআরসিটির ১০টি এসি বাস চলাচল করবে। লেন আলাদা হয়ে গেলে দুই পাশে যানবাহনের চাপ বাড়বে। একদিকে ট্রাফিক পুলিশের স্বল্পতা আছে, অপরদিকে কাজের চাপও বাড়বে। সবমিলিয়ে একটু সমস্যায় আছে ট্রাফিক বিভাগ।

তবে তিনি নিশ্চিত করেন, আমরা এই সড়কে অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রিত করতে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ নিয়োজিত করবো।

বিআরটিসির ব্যবস্থাপক নূর-ই-আলম বলেন, এখন আমরা দুটি বাস দিয়েছি। উদ্বোধনের পর সকাল সাড়ে ৬টা বা ৭টা থেকে শুরু করে আধাঘণ্টা পরপর শিববাড়ি থেকে গুলিস্থান পর্যন্ত চলাচল করবে।

বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, প্রকল্প পুরোটা এখন উদ্বোধন হচ্ছে না, বিআরটিসির বাস চলাচলের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সবগুলো স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ, লিফট ও এক্সেভেটরসহ ফিনিসিংয়ের কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলোর কাজও চলমান রয়েছে। এ ছাড়া বিআরটি লেন আলাদা করার জন্য লোহার পাত দিয়ে ডিভাইডার লাগানোর কাজও চলামান আছে। এখন বিআরটিসি বাস চলাচল করবে পাশাপাশি অন্য কাজগুলোও চলবে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল বলেন, প্রকল্পটির শুরু থেকেই আমরা বিরোধিতা করে আসছি। তারপরও সরকার কাজটি করেছে। এতো টাকা খরচ করে কাজটা যেহেতু হয়ে গেছে তাই এখন আর বিরোধিতা করছি না। এখন বলছি, অপারেশনটা যাতে ভালো করে করা হয়। গাজীপুর থেকে টঙ্গী আনেক পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকদের চলাচল করার জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত রাখা হয়নি। এ ছাড়া অনেক সমস্যা রয়েছে।

শিহাব খান/এএমকে