‘চিকিৎসক হয়ে হার্টের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন, হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে অতঙ্কিত করে তোলেন’- এমন সব অভিযোগের তদন্ত না হতেই এবার ‘ভুল চিকিৎসায়’ দুজন রোগীর মৃত্যুর লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহিন শাহ।

ডা. শাহিন শাহের আপন খালু রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আফজাল হোসেন (৬৫) রিং পরানোর পর মারা যাওয়ায় ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।

অন্যদিকে ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় স্বামী লাল মিয়া (৫০) মারা যাওয়ার আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গুজাপাড়া গ্রামের মোসা. ফরিদা বেগম।

দুটি অভিযোগের কপি ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এ নিয়ে ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বাণিজ্য ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর চারটি লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের কপি দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রমেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে ডাকযোগে ও সরাসরি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে গত ৭ ডিসেম্বর অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হরিপদ সরকারকে সভাপতি ও হাসপাতালের উপপরিচালক আ.ম. আখতারুজ্জামানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এতে সদস্য রয়েছে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইদুজ্জামান। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

গত ৮ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় প্রধান ডা. হরিপদ সরকার স্বাক্ষরিত (স্মারক নং-২০২৪/১২/০৮/০১) পত্রে ‘ক্যাথল্যাবে অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংক্রান্ত’ বিষয়ে বক্তব্য ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে ডা. মাহবুবুর রহমানকে লিখিতভাবে তলব করেছেন।

অন্যদিকে হাসপাতালের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও নার্সরা ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি বিক্রির অভিযোগ দিলেও কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হরিপদ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ সংক্রান্ত কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ সাংবাদিকদের হাতে এসেছে।

এদিকে ডা. শাহিন শাহ লিখিত অভিযোগে বলেন, ডা. মাহবুবুর রহমান আমার পূর্বপরিচিত, ঘনিষ্ট ও সহকর্মী হওয়ার বিশ্বাসের জায়গা থেকে তার অধীনে আমার খালুকে ভর্তি করি। ডা. মাহবুবুর রহমান আমার খালুর এনজিওগ্রাম করেন ০৭/১১/২০২৩ তারিখ সকালে। রিং পরানোর সময় ‘আর্টারি পারফোরেশন’ হয়ে গেলে অর্থাৎ হার্টের রক্তনালীতে ফুটা হয়ে গেলে রক্তক্ষরণে আমার খালু ওইদিনই (০৭/১১/২০২৩ তারিখ) কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান। ‘আর্টারি পারফোরেশন’ হয়ে গেলেও ডা. মাহবুবুর আমাকে বা মেডিকেলে উপস্থিত আমার খালাকে কিছুই জানাননি বরং তিনি রিং লাগানোর কার্যক্রম বন্ধ করে রেজিস্ট্রার খাতায়
‘ক্যানসেল’ লিখেন এবং ভুল ও অবহেলায় আমার খালুর মৃত্যুর দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। এনজিওগ্রাম ও রিং পরানোয় ভুল ও অবহেলা হওয়ায় আমার খালু মারা যান।

তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু জাহেদ বসুনিয়া স্যারের নিকট জানতে পারি যে উক্ত রক্তনালীতে রিং না পরালেও চলতো। ডা. মাহবুবুর রহমানের প্রভাবের কারণে এতদিন অভিযোগ করতে পারেননি। আমি জেনেছি যে ডা. মাহবুবুর রহমান রিং বিক্রির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেন। এমনকি তিনি অননুমোদিত ভুয়া ডিগ্রি এমডি (কার্ডিওলজি) ব্যবহারও করেন।

এদিকে মোসা. ফরিদা বেগম তার লিখিত অভিযোগে বলেন, এ বছরের ২৭ নভেম্বর ডা. মাহবুবুর রহমান তার স্বামী লাল মিয়ার এনজিওগ্রাম করেন এবং অপারেশন করে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরান। প্রেসার কম থাকার পরও রিং পরানো হয়। এর চারদিন পর ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১ ডিসেম্বর আমার স্বামী মারা যান।

দুটি গরু ও মানুষের নিকট টাকা চেয়ে চিকিৎসার টাকা সংগ্রহ করেছিলেন উল্লেখ করে ফরিদা বলেন, আমার স্বামীর রিং লাগানোর মতো অবস্থা ছিল না এবং ডা. মাহবুবুর রহমান ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে আমার স্বামী মারা গেছেন। তিনি ডা. মাহবুবুর রহমানের চিকিৎসা পেশা থেকে বরখাস্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানান।

এর আগে ডা. মাহবুবুর রহমানের রিং বাণিজ্যে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে অভিযোগ করেন দুইজন ভুক্তভোগী মোহা. মশিউর রহমান ও আতোয়ার রহমান।

আতোয়ার রহমান অভিযোগ করেন, ডা. মাহবুবুর রহমান তিনটি রিং লাগোনোর কথা বলে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন কিন্তু রিং লাগিয়েছেন একটি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে অভিযোগ হওয়ায় নিজেকে বাঁচাতে মাহবুবুর রহমান হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার খাতায় একটি রিং এর স্টিকারের পাশে জালিয়াতি করে আরেকটি রিং পরানোর স্টিকার বসিয়েছেন যাতে মনে হয় তিনি দুটি রিং পরিয়েছেন আতোয়ারকে। সেই রেজিস্টার খাতার বর্তমান ও আগের স্টিকার লাগানো ছবি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ভুক্তভোগীর ছেলে মোহা. মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন, পেটে ব্যথা হলে ১৮ সেপ্টেম্বর ডা. মাহবুবুর রহমান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করেন এবং বলেন যে তার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে ৭৫ শতাংশ ব্লক আছে তা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে রিং (স্টেন্ট) পরাতে হবে। কিন্তু তিনি যখন এনজিওগ্রামে সিডি অন্য দুজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখালে বলেন যে হাটের রক্তনালীতে কোনো ব্লক নেই।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেকটা রোগীর হার্টে রিং স্থাপনের পর তাকে রিপোর্ট কপি এবং সিডি দেওয়া হয়। সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকে। এর পরও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে এটা দুঃখজনক।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান জানান, আগে দুজন ভুক্তভোগীর দেওয়া দুটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ওই চিকিৎসক দোষী কিনা এবং তদন্ত কমিটির মতামত দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নতুন করে আরও একটি অভিযোগ এসেছে, সেটি ডা. শাহীন শাহ নামে এক চিকিৎসক দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর