রাজবাড়ী বিআরটিএ
দালাল ধরলে পরীক্ষা ছাড়াই মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) রাজবাড়ীর দপ্তরে ভোগান্তির শেষ নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে একাধিকবার ধরনা দিতে হয় বিআরটিএ অফিসে। এ ছাড়াও টাকা ছাড়া মেলে না গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট। দালাল বা সাধু বাবা ধরলে পরীক্ষা ছাড়াই মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স।
অভিযোগ রয়েছে, চাহিদামতো ঘুষ না দিলে কিংবা দালাল ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে লাইসেন্স প্রত্যাশীদের। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা এবং ফিল্ড (মাঠ) টেস্টে পাস করার পর নির্ধারিত ফি জমা পর্যন্ত চলে ঘুষের কারবার। আবার লিখিত পরীক্ষায় ফেল করলে কর্মকর্তার সুপারিশ হলে দিতে হয় না মৌখিক পরীক্ষা ও ফিল্ড টেস্ট। স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাতে ম্যাসেজ চলে যায় পাসের।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি রাজবাড়ীর বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা চলাকালীন অনুসন্ধানের সময় ব্যাপক অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে।
প্রতিদিনের মতো গত বুধবার (৪ ডিসেম্বর) আবেদনকারীর মধ্যে ১০১ জন ড্রাইভিং লাইসেন্সের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষার সময় সহকারী কমিশনার মোল্লা ইফতেখার আহমেদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকদের উপস্থিতির পর তিনি পরীক্ষাকেন্দ্রে আসেন। ততক্ষণে পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ খাতা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী পিয়ালের হাতে। যদিও রাজবাড়ী বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের দাবি খাতাগুলো সিরিয়াল করছিলেন পিয়াল।
সেখান থেকে বিআরটিএ দপ্তরে যাওয়ার সময় হট্টগোল দেখা যায়। ঘুষের টাকা ফেরত পেতে বিআরটিএ কার্যালয়ের অফিস সহায়ক গোলাম মোস্তফাকে আটক করেন এক ভুক্তভোগী। ঘুষের টাকার দেনদরবার নিয়ে তাদের মধ্যে হট্টগোল শোনা যায়। সাংবাদিকের উপস্থিতি বুঝতে পেরে দ্রুত সটকে পড়েন গোলাম মোস্তাফা। তিনি ২০১৮ সালের ৩ জুন রাজবাড়ীতে যোগদান করেন। যোগদানের পর তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। গতকাল বিষয়টি জানাজানির পর ছুটির আবেদন করেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। মুঠোফোনে তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়াও বিআরটিএ অফিস থেকে মৌখিকভাবে তথ্য চাইলে গড়িমসি ও সংবাদকর্মীদের লাঞ্ছিত করেন অফিসের কর্মকর্তারা। ওইদিন বিআরটিএ কার্যালয়ের ভেতরে অনিয়মের সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে যান প্রেসক্লাবের সহসভাপতি আব্দুল কুদ্দুস বাবু। এ সময় তাকে অফিসের উচ্চমান সহকারী বিপ্লব হোসেন ধাক্কা দেন ও ধমক দিয়ে লাঞ্ছিত করেন।
এ ব্যাপারে আব্দুল কুদ্দুস বাবু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিআরটিএ দপ্তরে অনিয়ম চলে আসছে, সেই অনিয়মের সংবাদ সংগ্রহের কারণেই আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় উচ্চমান সহকারীর এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন জেলায় কর্মরত সব সংবাদকর্মীরা।
কথা হয় বিভিন্ন পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে। ঢাকার হেমায়েতপুর এলাকায় গাড়ি চালান নাবিল আহম্মেদ। সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজবাড়ীতে ঘুষের বিনিময়ে মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স। দালালের মাধ্যমে ১৩ হাজার চুক্তিতে আবেদন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি অনলাইনে আবেদনের জন্য দালালকে ৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। লাইসেন্স প্রাপ্তির ধাপে ধাপে এই টাকাগুলো পরিশোধ করতে হবে বলে জানান তিনি।
তোতা নামের আরেক পরীক্ষার্থী বলেন, আমি জেলার জাপান মোটরসের মাধ্যমে আবেদন করেছি। রাজবাড়ীতে বেশিরভাগ মানুষ শোরুমের মাধ্যমে আবেদন করে। ১১ হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকার চুক্তিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। তবে শোরুমের মাধ্যমে আবেদন করলে লিখিত পরীক্ষাসহ মৌখিক পরীক্ষা ও ফিল্ড টেস্ট দিতে হয় না। মৌখিক ও ফিল্ড টেস্ট না দিয়েই চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণের অভিযোগ রয়েছে রাজবাড়ীর বিআরটিএর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরদার নামে এক পরীক্ষার্থী নভেম্বর মাসে ২৭ তারিখ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য রাজবাড়ী বিআরটিএতে পরীক্ষা দেন। কিন্তু তিনি লিখিত পরীক্ষায় ফেল করেন। পরে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার জন্য সুপারিশ করলে তার ভাইভা ও ফিল্ড টেস্ট ছাড়াই পাস করে যান।
একই দিনে পরীক্ষা দেন সদর উপজেলার আরেক পরীক্ষার্থী। তার সঙ্গে সরদারের কথোপকথনের একটি স্ক্রিনসট ঢাকা পোস্টের হাতে রয়েছে। এক পরীক্ষার্থী সরদারকে রেখেন, ‘ভাইভা ও প্রাকটিকাল না দিয়েই পাস করে গেলা, তুমিই তো ভালো করেছো। আর আমি সারাদিন ওখানে ব্যয় করলাম।’ উত্তরে সরদার লেখেন, ‘হ ভাই, আলহামদুলিল্লাহ।’
গত ২৭ নভেম্বর সরেজমিনে রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠে ড্রাইভিং লাইসেন্সের সর্বশেষ ধাপ ফিল্ড টেস্টের সময় উপস্থিত থেকে দেখা যায়, অফিস সহায়ক গোলাম মোস্তফা কয়েকজনের কাছ থেকে লার্নারের কাগজ নিচ্ছেন, এরপর পরীক্ষার্থীদেরকে চলে যেতে বলছেন। এমন একজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। পরীক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হয় ফিল্ড টেস্ট না দিয়েই চলে যাচ্ছেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি প্রাইভেটকার চালাতে পারি না। ফিল্ড টেস্ট দিয়ে কি করবো। আমি ওই ব্যক্তিকে (মোস্তফা) ১০ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছি। তিনি সব করে দেবেন। এজন্য লার্নারের কাগজটা তার কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছি।’
এরকম কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে ফিল্ড টেস্ট না দিয়ে মোস্তফার কাছে লার্নারের কাগজ জমা দিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে।
পরিচয় গোপন করে ওইদিন পরীক্ষার্থী সেজে অফিস সহায়ক গোলাম মোস্তফার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কাজ করে দেওয়া যাবে কিনা। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয়।’ তাকে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে ওদের কাগজ রেখে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন কেন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিত। আমার বন্ধু আমাকে এখানে আসতে বলেছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাই এসেছি।’ এরপর তাকে আরও প্রশ্ন করতেই তিনি স্থান ত্যাগ করেন।
রেলওয়ে মাঠে অবস্থানকালে রাজবাড়ী আদালতের এক বিচারকের গাড়ি চালকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, রাজবাড়ী বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসান টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। টাকা দিলেই তিনি দেন ফিটনেস সার্টিফিকেট, আর টাকা না দিলে দেন না। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা নিউজ করে কি করবেন। আজ নিউজ করবেন, এক সপ্তাহ ঠিক থাকবে। তারপর যা তাই হয়ে যাবে।’
গত বুধবার অনুসন্ধানকালে ডিসি অফিস চত্বরে কথা হয় এক সরকারি অফিসের অফিস প্রধানের গাড়ি চালকের সঙ্গে। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, বিআরটিএ দপ্তরে ঘুষ আর টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আমাদের দপ্তরের কোন স্যারেরা কীভাবে টাকা নেন তা বোঝাই যায় না। ঘুষের টাকাগুলো বিআরটিএ দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে।
আল আমিন শেখ নামের এক পরীক্ষার্থী বলেন, রাজবাড়ী বিআরটিএ অফিসে পরীক্ষা না দিয়েই সাধু বাবার মাধ্যমে (দালাল) পরীক্ষায় উপস্থিত না থেকেও, পরীক্ষায় ফেল করলেও তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ আমরা যারা পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ভালো নম্বর পেয়েছি তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছি না। রাজবাড়ী থেকে এই সাধুবাবা (দালাল) উচ্ছেদ করা জরুরি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা আছেন আশা করি তারা ব্যবস্থা নেবেন।
পাংশা মৌরাট ইউনিয়নের আসাদ বিশ্বাস নামের এক পরীক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গত মাসের ৩০ তারিখে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য রাজবাড়ী বিআরটিতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ২০টি প্রশ্নের মধ্যে আমি ১৮টি উত্তর দিয়েছিলাম। আমার ১৪টি উত্তর কনফার্ম ছিল। ২০-এর মধ্যে ১২ পেলে পাস। কিন্তু আমি ১৪টি কনফার্ম উত্তর দিয়েও আমার ফেল আসে। তাই আমি আবার পরীক্ষা দিই। নিজ যোগ্যতায় আমি পাস করি। আপনাদের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আজ স্বচ্ছ পরীক্ষা হয়েছে। আমরা চাই সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রত্যেকটি সরকারি অফিস দুর্নীতিমুক্ত হোক।
জানা গেছে, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজবাড়ী বিআরটিএ অফিসে নেই সহকারী পরিচালক। মোটরযান পরিদর্শকের পদটিও শূন্য। গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি পদে যে দুই কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন তারা অফিস করেন সপ্তাহে মাত্র এক থেকে দুইদিন। এরমধ্যেই সহকারী পরিচালক বদলি হয়ে গেছেন। আর এ সুযোগে অফিসেরই কিছু অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে এ অফিসে রামরাজত্ব কায়েম করছেন শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট।
এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন কালাম, লিয়াকত, মাহফুজ, আশিক ও পিয়ালসহ বেশ কয়েকজন। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা থেকে শুরু করে দাফতরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন চিহ্নিত এসব দালালরা।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী বিআরটিএ সহকারী পরিচালক মো. এমরান খান ও মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
রাজবাড়ী অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহুয়া শারমিন ফাতেমা বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা হচ্ছে রাজবাড়ী বিআরটিএকে দালালমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত করা। এ বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাছে যদি নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসে আমরা সেই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আপনাদের কাছে যে অনিয়মের তথ্যগুলো আছে সেগুলো আমাকে দেন। আমি অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের রাজবাড়ি বিআরটিতে নিয়মিত অফিসার নেই। সহকারী পরিচালক এবং মোটরযান পরিদর্শক দুজনই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। একজন রেগুলার অফিসার দেওয়ার জন্য বলেছি। অফিসার আসলে আমরা যেসব সমস্যাগুলো সম্মুখীন হচ্ছি তা থেকে দ্রুতই বের হয়ে আসতে পারবো।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/এএমকে