বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিনিয়তই দেশের যুবকরা বৈধ-অবৈধ পথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। সরকার বারবার বিভিন্ন মাধ্যমে বৈধ পথে বিদেশ যেতে উৎসাহিত করলেও এক শ্রেণির দালালদের খপ্পরে পড়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বপ্নের দেশে যেতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমান তরুণরা। ভাগ্য সহায় হলে বিভিন্ন দেশের কাঁটাতার ফাঁকি দিয়ে পৌঁছাতে পারেন স্বপ্নের দেশে। আর ভাগ্য সহায় না হলে কারও লাশ ফিরে আসে দেশে। আবার কারও লাশও খুঁজে পান না স্বজনরা।

দালাল কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খার খপ্পরে পড়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে ৯ মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের ২৪ যুবক। এদের মধ্যে  ১৫ জন মাদারীপুরের ৯ জন রয়েছেন। নিখোঁজ ওই ২৪ যুবক বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তা স্বজনদের কেউ জানেন না। নিখোঁজ ২৪ যুবকের বাড়িতে ৯ মাস ধরে চলছে কান্না আর শোক। আইন-আদালতের মাধ্যমে বুকের মানিককে ফিরে পেতে মামলা করলে এসব যুবকদের স্বজনদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খা।

নিখোঁজ যুবকদের স্বজনরা জানান, উন্নত জীবনের আশায় শরীয়তপুরের আংগারিয়া ইউনিয়নের তুলাতলা গ্রামের নূর ইসলাম খানের ছেলে মানবপাচারকারী কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খার মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়েছিল তুলাতলার ১৫ জন ও পার্শ্ববর্তী মাদারীপুরের ৯ জন যুবক। অবৈধ পথে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছানোর কথা ছিল তাদের। কিন্তু লিবিয়াতে মাফিয়া চক্রের হাতে পড়ে গত ২২ মার্চ থেকে প্রত্যেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। এরপর থেকেই শরীয়তপুরের তুলাতলা, চর যাদবপুর, চর চটাং ও মাদারীপুরের নতুন বাজার, জাগীর, সূর্যমনি গ্রামের ২৪ যুবক নিখোঁজ। কেউ নাতি, কেউবা ছেলে আবার কেউ স্বামী হারিয়ে ৯ মাস যাবত পাগলপ্রায়। ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দালাল কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খা ভুক্তভোগী প্রত্যেক পরিবার থেকে নিয়েছেন ১২ থেকে ১৮ লাখ টাকা। লিবিয়াতে ২৪ যুবক নিখোঁজ হওয়ার পরে দালালরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলে উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন দালাল কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খা।

নিখোঁজরা হলেন- শরীয়তপুরের তুলাতলা এলাকার চরচটাং গ্রামের জাহাঙ্গীর মোড়লের ছেলে রফিক মোড়ল, ইকবাল কাজীর ছেলে শামীম কাজী, আব্দুল মান্নান ওজার ছেলে মিরাজ ওজা, চর নেয়ামাতপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান খানের ছেলে আতিকুর রহমান, সলিম জমাদ্দারের ছেলে রাশিদুল ইসলাম, বোরহান মৃধার ছেলে সিরাজ মৃধা, দক্ষিণ ভাষাণচর গ্রামের সালাম আকনের ছেলে দিদার হোসেন, ইদ্রিস আলী খার ছেলে আমিনুল ইসলাম, সুফিয়ার সরদারের ছেলে ফারুক সরদার, দরিচর দাদপুর গ্রামের হাতেম শেখের ছেলে জাফর শেখ, কদমতলী গ্রামের সালমান শিকদারের ছেলে শাহিন শিকদার, দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের চুন্নু ভূইয়ার ছেলে আল আমিন, চর যাদবপুর সিরাজ মোল্লার ছেলে সাইদ মোল্লা, মানিক ফরাজীর ছেলে শহিদুল ফরাজী ও স্বর্ণঘোষ গ্রামের আব্দুল মালেক ফকিরের ছেলে আল আমিন ফকির। এছাড়াও মাদারীপুরের ত্রিভাগদি গ্রামের রহিম হাওলাদারের ছেলে শাহজাহান হাওলাদার, জাফরাবাদ গ্রামের ইউনুস শিকদারের ছেলে দিপু শিকদার, সূর্যমনি গ্রামের ফারুক পেদার ছেলে সাইফুল ইসলাম, জাগির গ্রামের শাহজাহান খানের ছেলে পারভেজ খান, চাপাতলী গ্রামের শাহ আলম সরদারের ছেলে সরদার সাকেবুল, নতুন বাজার গ্রামের খালেক মোল্লার ছেলে আলনিদ রিমন মোল্লা, হাবিব হাওলাদারের ছেলে সিয়াম হাওলাদার, আব্দুল বেপারীর ছেলে নাহিদ বেপারী ও ডাসার থানার হাবিব বেপারীর ছেলে নাইম হোসেন বেপারী।

শরীয়তপুরের দক্ষিণ ভাষাণচর এলাকার নিখোঁজ ফারুক সরদারের বাবা সুফিয়ার সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা থানায় গিয়েছিলাম, কোর্টে গিয়েছিলাম। আমাদের মামলা গ্রহণ করেনি। থানা বলে কোর্টেু যাও, কোর্ট বলে থানায় যাও। আগে যে ওসি ছিলেন তিনি দালালের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এই কাজ করেছেন। যদি টাকা না খেয়ে থাকে তাহলে মামলা নেবে না কেন? এরপর সরকার উলোট-পালট হলো। দালাল টুন্নু ও রাসেদ আওয়ামী লীগ করতেন। তারা সব জায়গায় টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করে রাখত, যেন আমরা বিচার না পাই। আমরা থানা পুলিশ করতে গেলে উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেন তারা। আমি আমার ছেলেসহ ২৪ যুবকের সন্ধান চাই।

নিখোঁজ আতিকুর রহমানের বাবা মান্নান খান বলেন, দালাল রাসেদ ও টুন্নু আমার কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা  নিয়েছে ইতালি পৌঁছে দেবে বলে। কিন্তু গত মার্চের ২২ তারিখ থেকে আমার ছেলেসহ ২২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। আমার টাকা চাই না, বিদেশ লাগবে না। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।

নিখোঁজ ফারুকের মা মাহফুজা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তুলাতলা বাজারে গিয়েই আমার ছেলের মাথা খারাপ হইছিল। সৌদি, মালয়েশিয়া পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফারুক ইতালি যাবেই। এরপর অবাধ্য হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে আমার বুকের মানিক নিখোঁজ হয়েছে। আমার টাকা-পয়সা লাগবে না, আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।

বিষয়টি নিয়ে জানার জন্য কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খার বাড়িতে গেলে তাদের বসতবাড়ি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। তবে কামরুজ্জামান টুন্নু খা ও রাসেদ খার চাচি পরিচয় দেওয়া এক নারী বলেন, বিদেশে লোক পাঠাত রাশেদ ও টুন্নু। তারা সম্পর্কে আমার ভাসুরপুত্র হয়।

বিষয়টি নিয়ে কোনো তথ্য নেই জেলা পুলিশের কাছে। তবে অভিযোগ পেলে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। যারা শরীয়তপুরের মানবপাচারকারী, তাদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। লিবিয়াতে যেহেতু নির্বাচিত কোনো সরকার নেই। তাই দালালদের প্ররোচনায় বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে লিবিয়া দিয়ে সমুদ্রসহ অন্যান্য পথে মানবপাচার করা হয়, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। খোঁজখবর নিয়ে দালালদের শাস্তি নিশ্চিতকরণসহ অভিযোগের ভিত্তিতে নিখোঁজদের উদ্ধারে কাজ করবে পুলিশ।

প্রসঙ্গত, মানবপাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিখোঁজদের সন্ধান পেতে মানববন্ধনসহ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সেনা ক্যাম্প ও শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন ও স্বারকলিপি দিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।

সাইফ রুদাদ/আরএআর