রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন
রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা রিং বাণিজ্যসহ প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন সদস্য নিয়ে গঠিত এ কমিটিতে কারা রয়েছে এবং কত কার্যদিবসে প্রতিবেদন দাখিল করবে তা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশে অপারগতা জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শনিবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে কমিটির সদস্যসহ প্রতিবেদন দাখিলের দিনক্ষণ এখনই প্রকাশ না করা ভালো।
রমেক হাসপাতালের পরিচালক বলেন, দুজন ভুক্তভোগীর দুটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ওই চিকিৎসক দোষী কিনা এবং তদন্ত কমিটির মতামত দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
এদিকে ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুজন ভুক্তভোগী রোগী দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ও রমেক হাসপাতাল পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে রিং বাণিজ্যসহ প্রতারণার অভিযোগ দিয়েছেন। দুদক রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই কমিশনের সভায় অভিযোগ তুলে ধরা হবে। অন্যদিকে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পাওয়া প্রতারণার অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠনে প্রতিনিধি চেয়ে রমেক অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়েছে সিভিল সার্জনের কার্যালয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ডা. মাহবুবুর রহমান দীঘদিন ধরে হার্টে সার্জারি করে নিজেই রিং বিক্রি করে স্থাপন করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে বিভিন্নভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিতে এনজিওগ্রাম, সার্জারি, রিং স্থাপনসহ নানান রকম সেবার অন্তরালে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। যা নিয়ে বিভিন্ন সময়েও রোগীরা প্রতিবাদ জানালেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।
সম্প্রতি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসাসেবা নিতে এসে প্রতারণার শিকার হয়েছেন দাবি করে ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছে আতোয়ার হোসেন ও মশিউর রহমান নামে দুজন ভুক্তভোগী। সেই অভিযোগের কপি দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রমেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে সরাসরি ও ডাকযোগে পাঠিয়েছেন তারা।
গাইবান্ধা সদরের কুমারপাড়া গ্রামের আতোয়ার হোসেন (৪৫) তার ওই লিখিত অভিযোগে বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মাহবুবুর রহমান প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত হাসপাতালে আমার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) পরিয়ে তিনটি রিংয়ের টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন। ডা. মাহবুবুর রহমান রিং পরানোর যে সিডি দিয়েছেন তাতে রিং লাগানোর কোনো নজির নেই তবে হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় একটা রিং পরানোর রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু ডা. মাহবুবুর তিনটি রিং লাগানোর কথা বলে আমার নিকট থেকে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন।
আতোয়ার হোসেন জানান, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর হার্ট অ্যাটাক হলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে ভর্তি হন তিনি। এনজিওগ্রাম করে ডা. মাহবুবুর জানান যে, হার্টের রক্তনালীতে তিনটি ব্লক আছে এজন্য পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। এর পর ৯ শতক জমি বিক্রি তিনটি রিংয়ের জন্য মেডিকেলের এমএলএস শহিদুল ইসলামের সহায়তায় তিন লাখ ২০ হাজার টাকায় তিনটি রিং পরাতে রাজি হন ডা. মাহাবুবুর। রিং পরানোর পর অবস্থার উন্নতি না হলে কয়েকদফা ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ডা. মাহাবুবুরের অধীনে। এরপরও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে আতোয়ার এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হাসানুল ইসলামের অধীনে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়ে সুস্থ হন। এ সময় জানতে পারেন তার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরানো হয়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মোহা. মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, পেটে ব্যথা হলে তার মাকে রংপুর মহানগরীর কছির উদ্দিন মেডিকেলে এ বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ডা. জিয়াউর রহমানের নিকট দেখাতে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পিত্তথলির অপারেশন করাতে হবে বলে জানান এবং অপারেশনের আগে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের নিকট চেক করে নিতে পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মোতাবেক ১১ সেপ্টেম্বর তার মাকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মাহবুবুর রহমানের নিকট তার চেম্বার রংপুর সেন্ট্রাল হাসপাতালে দেখালে তিনি এনজিওগ্রাম করাতে বলেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ডা. মাহবুবুর রহমান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করেন। এবং বলেন যে তার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে ৭৫ শতাংশ ব্লক আছে, তা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে রিং (স্টেন্ট) পরাতে হবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাদের সন্দেহ হলে ঢাকা ন্যাশন্যাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. বদিউজ্জামানকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এনজিওগ্রামের সিডি (রেজি নং ১২৫২২/৩২) দেখালে তিনি বলেন যে আমার মায়ের হার্টে কোনো প্রকার ব্লক নেই। এরপর রংপুরে এসে ১৫ অক্টোবর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাসানুল ইসলামকে দেখালে তিনিও বলেন যে আমার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে কোনো ব্লক নেই। তবে তিনি সামান্য কিছু ওষুধ খেতে পরামর্শ দেন। এতে আমার মায়ের যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো ভালো হয়ে যায়। অতঃপর ৭ নভেম্বর ডা. মোহা. মিজানুর রহমানের অধীনে পিত্তথলির অপারেশন করানো হয়।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিনিয়তই রিং বাণিজ্য করে যাচ্ছেন ডা. মাহবুবুর রহমান। তিনি এজন্য বিজ্ঞাপনও দেন তার ভিজিটিং কার্ড ও ফাইল ফোল্ডারে। যেখানে লেখা রয়েছে ‘সুখবর সুখবর সুখবর! আর নয় ঢাকা, আর নয় ইন্ডিয়া। এখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই অতি অল্প খরচে হার্টের এনজিওগ্রাম, হার্টের রক্তনালীতে স্টেন্ট (রিং) বসানো (এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্টিং) মাইট্রাল ভালভুলোপ্লাস্টি ও হার্টের পেসমেকার স্থাপন করছেন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান।’ রিং বিক্রি বাড়াতে এভাবেই নিজের বিজ্ঞাপন দেন ডা. মাহাবুবুর, যা বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ অনুযায়ী অপরাধ।
ডা. মাহবুবুর রহমান তার ভিজিটিং কার্ডে ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিএমডিসির এমডি (কার্ডিওলজি), এফএসিসি (আমেরিকা) এ ধরনের ভুয়া ডিগ্রি লিখে প্রলুব্ধ করেন রোগীদের। বিএমডিসির অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের প্রচারণা অনুচিত। কারণ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ এর ধারা ২৯ (১) বলা হয়েছে ‘এই আইনের অধীনে কোনো মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক এমন কোনো নাম, পদবি, বিবরণ বা প্রতীক এমনভাবে ব্যবহার বা প্রকাশ করিবেন না যার ফলে তার কোনো অতিরিক্ত পেশাগত যোগ্যতা আছে মর্মে কেউ মনে করেন, যদি না তা কোনো স্বীকৃত মেডিকেল চিকিৎসা শিক্ষা যোগ্যতা বা স্বীকৃত ডেন্টাল চিকিৎসা শিক্ষা যোগ্যতা হয়ে থাকে।’ এই ধারা ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেকটা রোগীর হার্টে রিং স্থাপনের পর তাকে রিপোর্ট কপি এবং সিডি দেওয়া হয়। সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকে। এর পরও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে এটা দুঃখজনক।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর