জন্মের মাত্র পাঁচ মিনিটের ছোট জাহিদ ও বড় নাহিদ। দুই ভাইয়ের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পড়াশোনা একইসঙ্গে। একই কলেজে ভর্তিও হয়েছেন তারা, দেবেন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তার আগেই দুই ভাই একসঙ্গেই চাকরি পেলেন পুলিশের কনস্টেবল পদে। দুই ভাইয়েরই চাকরি হওয়ায় কৃষক বাবার যেন খুশির সীমা নেই।

নাহিদ হাসান ও জাহিদ হাসানের বয়স ১৯ বছর। তারা রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ধোরসা গ্রামের দরিদ্র কৃষক ইসাহাক আলীর ছেলে। তাদের মা সেলিনা বেগম গৃহিণী। বড় বোন ইসরাত জাহান রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার দুই ভাইয়ের প্রত্যেকে মাত্র ১৪০ টাকা খরচে আবেদনে পেলেন পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি।

বুধবার (৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ২টায় রাজশাহী জেলার ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। জেলা পুলিশ লাইন্সের ড্রিল শেডে মাইকে যখন এই ফল ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন জাহিদ আর নাহিদ বসেছিলেন সামনে। আর তাদের বাবা ইসাহাক আলী বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন অপেক্ষায়। তালিকার ৭ নম্বরে প্রথমে ঘোষণা করা হয় বড় ভাই নাহিদের নাম। এরপরই ১৭ নম্বরে ঘোষণা করা হয় জাহিদের নাম। দুই ছেলের নাম শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ইসাহাক আলী। খুশিতে চোখের পানি থামছিলই না নাহিদ ও জাহিদেরও।

বড়ভাই নাহিদ বলেন, আমরা কখনও ভাবিনি মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এত সহজে চাকরি হয়। আমাদের ধারণাই বদলে গেছে। আমরা খুব খুশি।

ছোটভাই জাহিদ বলেন, আমরা দুই ভাই একসঙ্গে জন্ম নিয়েছি, একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। একসঙ্গেই যে চাকরি হবে সেটা কখনও ভাবিনি। আমরা সবাই খুব খুশি। আমরা সততার সঙ্গে কাজ করতে চাই।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে জন্ম হয় দুই ভাইয়ের। এরপর মোহনপুরের মতিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একসঙ্গে পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হন তারা। পরে মতিহার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে একসঙ্গেই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন। জাহিদ পান জিপিএ ৪ দশমিক ৮৩, আর নাহিদ ৪ দশমিক ৯৪। এরপর দুই ভাই একসঙ্গেই দুর্গাপুরের দাওকান্দি সরকারি ডিগ্রি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। এখন দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। সামনে তারা একসঙ্গেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবেন।

জাহিদ ও নাহিদের বাবা ইসাহাক আলী বলেন, আমার দুই ছেলেকে কষ্ট করে বড় করেছি। আমি গরীব মানুষ কর্ম করে খাই। দুই পয়সা লাগলে আমার দেওয়ার সাধ্য ছিল না। সেই জায়গায় কোনো টাকা ছাড়াই যে চাকরি হলো, সেটা তো আমি ভাবতেও পারিনি আগে। আমার ধারণাই ছিল না যে, টাকা ছাড়াও সরকারি চাকরি হয়। দুই ছেলেকে বলে দিয়েছি—টাকা ছাড়াই চাকরি হয়েছে। সততার সঙ্গে চাকরি করতে হবে যাতে আমার মুখ থাকে।

জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় এবার ৭৬টি শূন্যপদের বিপরীতে কনস্টেবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। মোট ৭ হাজার ৬২২ জন পরীক্ষার্থী অনলাইনে আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে ৬ হাজার ২০১ জন প্রার্থী শারীরিক মাপ, কাগজপত্র যাচাই ও ফিজিক্যাল এনডুরেন্স টেস্টে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। শারীরিক সক্ষমতা যাচাই শেষে ৭২২ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। উত্তীর্ণ হন ২৪৫ জন। এরপর তারা মৌখিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এই পরীক্ষা শেষে রাজশাহী জেলার নিয়োগ বোর্ড ৭৬ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করে। এরমধ্যে নারী ১৬ জন, পুরুষ ৬০ জন।

বুধবার দিবাগত রাত ২টায় নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আনিসুজ্জামান ফল ঘোষণা করেন। এ সময় বোর্ডের আরও দুই সদস্য বগুড়া জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. আব্দুর রশিদ (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) ও নাটোর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মাহমুদা শারমীন নেলীও উপস্থিত ছিলেন।

ফল ঘোষণার পর এসপি মো. আনিসুজ্জামান বলেন, যারা কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেলেন তাদের অধিকাংশ হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসে এই চাকরি পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। একটি কৃষক পরিবার থেকে যমজ দুই ভাই চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন। এই নিয়োগের সব পর্যায়ে আমরা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা, সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছি।

শাহিনুল আশিক/এএমকে