বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এবং অস্ত্রের আঘাতে নেত্রকোণার ১৭ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন শ্রমজীবী। যারা নিতান্তই জীবন-জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকা শহরে।

তাদেরই একজন নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার নির্মাণ শ্রমিক তোফাজ্জল (২৩)। তার বাড়ি উপজেলার মাসকা ইউনিয়নের পিজাহাতি গ্রামে। বাবা মৃত আব্দুর রশিদ, তোফাজ্জল যাকে হারিয়েছিল আড়াই বছর বয়সে। মা হারেছা আক্তার পাঁচ সন্তানকে আগলে রেখেছিলেন ১৮ বছর ধরে। তিনি অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে এবং মানুষের সহযোগিতায় সন্তানদের বড় করেন ও তিন মেয়েকে বিয়ে দেন। কিন্তু সুখ তার কপালে সইলো না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিহত তোফাজ্জল পাঁচ বছর আগে জীবিকার তাগিদে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর এলাকায় যান। সেখানে তিনি নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর তার মা হারেছা আক্তার ও ছোট ভাই মোফাজ্জল হোসেনকে গ্রামের বাড়ি থেকে শ্রীপুরে তার কাছে নিয়ে যান। এভাবে বেশ ভালোই চলছিল তাদের তিনজনের পরিবার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট গাজীপুরের জৈনা বাজার থেকে একটি মিছিল, ভালুকা উপজেলার মাস্টারবাড়ি এলাকায় আসে। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজন দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করে। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে তোফাজ্জলকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এমনকি তার পকেটে থাকা মোবাইল ফোন ও টাকা পয়সাও ছিনিয়ে নেন তারা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তোফাজ্জল মারা যান। ৫ আগস্ট তোফাজ্জেলের মরদেহ গাজীপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বুঝে নেয় তার পরিবার। পরে ওই রাতেই নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় তার নিজ বাড়ি পিজাহাতি গ্রামে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা দাফন সম্পন্ন করেন।

সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম তোফাজ্জলকে হারিয়ে তার মা হারেছা আক্তার এখন দিশেহারা। সন্তান হারানোর বেদনায় কাতর হারেছা আক্তারের যখনই মনে পড়ে সন্তানের মুখখানি, তখনই ছুটে যান তার কবরের পাশে। অপলক চোখে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন সন্তানের চিরনিদ্রায় শায়িত কবরের দিকে। তার বুকভরা হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে যেন ভারী হয়ে ওঠে চারপাশের বাতাস।

হারেছা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তোফাজ্জলকে তার বাবা ছোট রেখেই মারা গেছে। এখন আমার ছেলের বয়স ২০ বছরের ওপরে। সে মারা যাওয়ার সময় মাত্র দুই কাঠা জমি রেখে গিয়েছিল। যা ছিল আমার একমাত্র সম্বল। পাশাপাশি আশপাশের মানুষ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আমাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এখন আমার ছেলে বড় হয়েছিল। ৪-৫ বছর আগে সে ঢাকা গিয়ে কাজ শুরু করেছিল। উপার্জন শুরু করলে কিছুদিন পরে আমাদেরকে তার কাছে ওখানে চলে যেতে বলে। তখন আমি এবং আমার ছোট ছেলে ওখানে চলে যাই।

আমার ছেলে কষ্ট করে সংসার চালাতো, আমি কোনো কাজ করতাম না। ছোট ছেলেকে বলেছিলাম কাজ করার জন্য। কিন্তু সে একদিন কাজ করলে আরেকদিন কাজ করে না। তখন আমি বাসায় থাকার পাশাপাশি একটি কাজ নিয়েছিলাম ছেলেকে সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর আমি নিজেও কাজটা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমিও বাড়িতে চলে এসেছি ছোট ছেলেকে নিয়ে।

সন্তান হত্যার বিচার চান কী না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি যে বিচার চাইব, আমি তো দেখে নাই কে আমার ছেলেকে হত্যা করেছ। আমি কার নামে মামলা করব? আমি তো কাউকেই দেখিনি। আমার ছেলে মারা যাবার পর আমি তাকে দেখেছি। গিয়ে দেখি তাকে সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে রেখেছে।

কোন আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন কী না? জানতে চাইলে বলেন, জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা সহযোগিতা দিয়েছিল। পাশাপাশি আরেকটি সংগঠন থেকে তিনি আরো এক লাখ টাকা পেয়েছি, কিন্তু সংগঠনের নাম মনে করতে পারছি না।

তোফাজ্জলের পিঠাপিঠি বোন পান্না আক্তার বলেন, আমার ভাই মারা যাওয়ার ৬ দিন আগে তার সঙ্গে আমার সবশেষ কথা হয়েছিল। সে ঠিক কিভাবে মারা গিয়েছে এটা আমি দেখিনি। তবে সবার কাছে শুনেছি, ওই দিন মিছিলের সময় এক ঘণ্টার মতো কারেন্ট ছিল না। তখন মিছিলে রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্রপাতি দিলে আমার ভাইকে তারা আঘাত করেছে। আমার ভাইয়ের শরীরে ভালো শক্তি ছিল। হয়তো তার সঙ্গে যখন পেরে উঠেছিল না, তখন তার পায়ে রামদা দিয়ে একটা কোপ দেয়। তখন সে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর লোকজন উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার ভাই তার পরিচিত কয়েকজনের সাথে ওখানে গিয়েছিল। তারাই এসে আমার মাকে খবরটি জানায় যে আমার ভাইকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়েছে। তারপর আমার বড় বোন এবং আমার মা হাসপাতালে যায় কিন্তু হাসপাতাল থেকে জানায় যে সে মারা গেছে।

তোফাজ্জল অনেক ভালো মানুষ ছিল বলেও জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পিজাহাতি গ্রামের আবুল কালাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, আমার যেন মতে ছেলেটা খুব ভালো ছিল। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব দুর্বল ছিল। তার বাবা তাদের ছোট রেখে মারা যায়। তখন তার মা খুব কষ্ট করে তাদের বড় করেছে। আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকায় সে আন্দোলন করছে। আন্দোলন চলাকালে সন্ত্রাসীদের হামলায় তার পায়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ লাগে এবং ওই হামলার পর সে মারা যায়। এখন প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি, এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার করা হোক।

উপজেলার ৫নং মাসকা ইনিয়ন পরিষদ সদস্য ফরিদ বাঙালী বলেন, ছেলেটির বাবা সে ছোট থাকতেই ছোট মারা গিয়িছিল। তারপর তাদের মা খুব কষ্ট করে মানুষ করেছে সন্তানদের। সবেমাত্র সে কামাই রুজি শুরু করেছিল। এর মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্কয়ার মাস্টাবাড়ি এলাকায় সে মারা যায়। আমার জানামতে ছেলেটা খুব ভালো ছিল। সে খুব সহজ সরল ছিল। তাদের বাড়ির অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন, তারা আর্থিকভাবে কতটুকু স্বাবলম্বী। আমি আমার পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাচ্ছি, এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের জন্য যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।

নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, আপনারা জানেন যে নেত্রকোণাতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ১৭ জন নিহত হয়েছেন। ১৭ জনের তালিকা আমাদের কাছে আছে। তাদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। তারপরও আমরা বলেছি যে, যার কিছু নেই তাকে একটা ব্যবস্থা করা হবে। যার জায়গা নাই তাকে জায়গা ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। যার ঘর নাই, তাকে ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। সেটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের হতে পারে, অথবা ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার মাধ্যমে হতে পারে। তোফাজ্জলের মা যদি ওখানেই থাকতে চান তাহলে তাদের জন্য আমরা আর্থিক সহযোগিতা করব। আমরা এটাও বলেছি যে আপনারা আশ্রয়ণ প্রকল্পে যেতে চান কিনা। কারণ আমাদের ঘর নির্মাণ করা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঘর ফাঁকা থাকে, সেটাও আমরা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি তাদের জন্য। তারপরও আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব তারা কোনটা চায়। এছাড়া অন্যান্য যতগুলো সরকারি সহযোগিতা আসবে তার সবটাই আমরা শহীদ পরিবার সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেব।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরকে