নিরুদ্দেশের ১৫ বছর পর ফিরে পাওয়া মাকে ঘর ছাড়া করেছেন ছেলে। ভরণপোষণ ও দেখভালের দায় এড়াতে গর্ভধারিণী মাকে রাস্তায় বের করে দিয়েছেন। ছেলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় প্রতিবেশীর বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন বৃদ্ধ নূরজাহান ওরফে হৈজরি বেগম। যেন অকুল পাথারে পড়েছেন। যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের দোগাছিয়া গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে। 

স্থানীয়রা জানান, নিখোঁজ মায়ের হদিস পেয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন ছেলে তাইজেল হোসেন। মাকে পেয়ে প্রথমদিকে আনন্দিতও ছিল তার পরিবার। কিন্তু মাসখানেক যেতেই মায়ের ফিরে আসার আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। একপর্যায়ে ছেলের কাছে বোঝা হয়ে ওঠেন গর্ভধারিণী মা। ভরণপোষণের দায় এড়াতে অসুস্থ মাকে ঘর থেকে বের করে দেন ছেলে তাইজেল।
 
জানা যায়, নুরজাহান ওরফে হৈজরি বেগম দোগাছিয়া গ্রামের মৃত মোনামদি বিশ্বাসের স্ত্রী। তাদের চার ছেলে ও দুই মেয়ে। ২০০৬ সালে নিখোঁজ হন হৈজরি বেগম। তার এক ছেলে কটা মিয়াকে পুলিশ আটক করে জেলে পাঠালে হৈজরি বেগম তাকে দেখতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। কিন্তু তারপর থেকে আর তিনি বাড়িতে ফেরেননি।

হৈজরি বেগমের ছেলে তাইজেলের পুত্রবধূ সোনিয়া খাতুন জানান, হারিয়ে যাওয়ার বেশ আগে থেকেই তার কাঁপুনি রোগ ছিল। হয়তো তিনি কারগার থেকে ফেরার পথে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এরপর স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে যান। আর হারানোর পর তার ছেলে-মেয়েরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো হদিস মেলাতে পারেননি। একপর্যায়ে তারা হালও ছেড়ে দেন। এমনকি তারা হৈজরি বেগমের মৃত্যু হয়েছে বলেই অনুমান করেন। এর মধ্যে তার ছেলে কটা মিয়াও জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় হৈজরি বেগমের ফিরে আসার গল্প। তাদের ভাষ্য, চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে যশোর সদরের ঝুমঝুমপুর যান দোগাছিয়ার মাজেদা বেগম। সেখানে রাস্তার পাশে হৈজরিকে পড়ে থাকতে দেখে তার ছেলেদের খবর দেন। বিষয়টি জানার পর ছেলে তাইজেল হোসেন ঝুমঝুমপুর থেকে র‌্যাবের সহায়তায় তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় রোগ-শোকে ক্লিষ্ট হৈজরি বেগম চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, তার স্মৃতিভ্রমও ঘটেছে। শরীর শুকিয়ে গেছে, মুখের অবয়বও পরিবর্তন হয়েছে। ভেঙে গেছে কণ্ঠস্বর। এসবের মধ্যেই সম্প্রতি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে তাইজেলের সন্দেহ। ইদানিং তার মনে হচ্ছে- এই নারী তার মা নন। আর এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি।

তবে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে হৈজরি বেগম তার দুই পুত্রবধূকে দেখিয়ে বলেন, এরা আমার বউমা আলাপচারিতায় এতদিন কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে তিনি জানান, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন। জেলখানায় ছেলেকে দেখতে যাওয়ার কথাও তার মনে আছে।

হৈজরি বেগমকে এক মাসের বেশি সময় ধরে দেখাশোনা করছিলেন তার দুই পুত্রবধূ। তারা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে তাইজেল হোসেন সন্দেহ করছে এই নারী তার মা নন। মুখের আকৃতি কিছুটা তার মায়ের মতো মনে হলেও তিনি অন্য নারী।

তাইজেলের স্ত্রী সোনিয়া খাতুন বলেন, এই নারী তার শাশুড়ি এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একথা তার স্বামী বিশ্বাসই করছেন না। এ কারণেই প্রায়ই তাকে (জোবেদা) মারধর করছেন। তাড়িয়ে দিতে বলছেন।

সোনিয়া খাতুন বলেন, বৃদ্ধ মানুষ ঠিকমতো চলতে ফিরতে পারেন না। তার সেবা যত্ন আমিই করছি। কিন্তু তাইজেল কিছুতেই মানতে চাইছেন না। তার একই কথা, এ আমার মা না; অন্য কেউ।

চুড়ামণকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, হৈজরি বেগম মানসিক প্রতিবন্ধী। তার পরিবারের কেউ বলছে হৈজরি তাইজেলের মা, আবার কেউ দাবি করছে না। তার পরিবারের সদস্যরা চেয়ারম্যানের কাছে বয়স্কভাতার কার্ড চেয়েছেন। কিন্তু চেয়ারম্যান দেননি।

জাহিদ হাসান/আরএ আর/এমএইচএস