দুর্নীতিতে বেপরোয়া সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ
অবসায়নাধীন সমিতিকে রংপুর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে অংশগ্রহণে সহায়তা, বিভিন্ন সমবায় নির্বাচন ও অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি হয়ে নিজের ফায়দা লুটে নিয়ে সমিতির কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বিক্রয়সহ নানা কর্মকাণ্ডের প্রমাণ মিলেছে রংপুর সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ রানার বিরুদ্ধে। সমবায়ের এই কর্মকর্তা দুর্নীতিতে বেপরোয়া।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে ৬১ নম্বর স্মারকে রংপুর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের আওতাধীন প্রাথমিক সমবায় সমিতি শেখপাড়া কৃষি সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং সদ্যপুষ্করণী ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে অবসায়নে ন্যাস্ত করা হয়। অবসায়নের ৩ ও ৩৩ নম্বর ক্রমিকে এ দুটি সমিতির নাম উল্লেখ রয়েছে। রংপুর সদর উপজেলা সমবায় অফিসার মাসুদ রানা অবসায়নাধীন সমিতি দুটির প্রতিনিধিকে কৌশলে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রতিনিধি ফরম, মনোনয়ন ফরম ও রেজুলেশন প্রতিস্বাক্ষর করেন। নির্বাচনে সদ্যপুষ্করণী ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রতিনিধি কৃষ্ণ রঞ্জন বর্মন স্বাধীন ২০২২-২০২৪ মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে পরিচালক হিসেবে ব্যবস্থাপনা কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞাপন
দেখা যায়, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ রানা যে সময়ে শেখপাড়া কৃষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের অবসায়কের দায়িত্ব পালন করেন ঠিক একই সময়ে রংপুর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে নির্বাচন কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি সরকার মনোনীত পরিচালক হিসেবেও ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুধু তাই নয়, ২০২০-২০২১ সালে রংপুর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের অডিট কর্মকর্তার সম্মানি হিসেবে চেকের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকাও গ্রহণ করেন।
এ নিয়ে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, অবসায়ন আদেশ বা নির্দেশের আগেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। দুই সমিতির প্রতিনিধিরা আগেই নির্বাচনের জন্য কাগজ জমা দিয়েছিল। তাই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ছিল না। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে চেক দিয়ে টাকা তোলার যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ বানোয়াট। নিশ্চয়ই কেউ আমার নামে চেক তুলেছে।'
বিভিন্ন সমবায় সমিতির দামি সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বিক্রয়ের আবেদন সুপারিশের জন্য মোটা অংকের টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মচারী সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতির একাধিক সূত্র জানায়, রংপুরের ধাপ শিমুলবাগ কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন ২৪ শতক জমি শতক প্রতি এ বছর বিক্রয় হয়েছে মাত্র ২৪ লাখ টাকা করে। যদিও শিমুলবাগ এলাকার স্থানীয়দের দাবি এখানে শতক প্রতি জমির মূল্য ৮০ লাখ টাকা। জমিটি বিক্রয় করা হয় সিডিডি হাউজিংয়ের কাছে।
সিডিডি হাউজিংয়ের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করা শর্তে বলেন, মাসুদ রানা আমার কাছ থেকেই ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন এই কাজটি করতে। তিনি আড়াই লাখ টাকা দাবি করেছিলেন।
ধাপ সাগরপাড়া নিবাসী মোসলেম, সাজু, ফিরোজসহ কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, ১০ বছর আগেও এই স্থানের জমি শতক প্রতি বিক্রি করা হয়েছে ৩০ লাখ টাকার ওপরে। বর্তমানে এর দাম ৮০ লাখ টাকার নিচে নয়। যদি ২৪ লাখ টাকা বিক্রি করা হয় তাহলে শুধুমাত্র কাগজে কলমে দেখানো হয়েছে। বাইরে অনেক টাকা লোপাট করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, শিমুলবাগ কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন জমিটি বিক্রি করার জন্য অনেকদিন মাসুদ রানা চেষ্টা করেছিল। পরবর্তীতে সমবায় যুগ্ম নিবন্ধক মৃণাল কান্তি বিশ্বাসকে সন্তুষ্ট করে জমিটি মোটা অংকে বিক্রি করেন। এতে ২০ কোটি টাকার ওপরে ফায়দা তোলেন মাসুদ রানা। বর্তমানে সিও বাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির চার শতক জমির প্রতি শতক ৪ লাখ টাকা করে বিক্রয়মূল্য অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু এই জমির শতক ১০ লাখের নিচে নয়। উক্ত জমির বিক্রয় কমিটিতে সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ রানা কৌশলে বিক্রয় কমিটিতে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করান। এখন পর্যন্ত জমিটি রেজিষ্ট্রেশন করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সেই কর্মকর্তা।
এছাড়াও বিভিন্ন সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রদানে আর্থিক দুর্নীতি ও নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে মাসুদ রানার বিরুদ্ধে। একটি অভিযোগে দেখা যায়, ১৯৮৭ সালে ব্র্যাকের পৃষ্ঠপোষকতায় হরিদেবপুর মধ্যপাড়া শ্রমজীবী পুরুষ ও মহিলা সমিতি গড়ে ওঠে। সংগঠনটির সদস্যরা ১৯৯১ সালে জমাকৃত টাকা দিয়ে ৫ দশমিক ৪১ একর জমি ক্রয় করে জমিতে পুকুর খনন করে মাছচাষ ও পুকুরের ধারে সবজি চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। জমি ক্রয়ের কাগজগুলো সাংগঠনিক সদস্য মহব্বর হোসেন গং-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে মূল সদস্য ও সদস্যাদের বাদ দিয়ে ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে মহব্বর হোসেন ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ১৪৪১৭, ১৪৪১৮, ১৪৪১৯, ১৪৪২০ নং দলিল মূলে ৩৯ জনের নিকট পুকুরটি বিক্রি করে দেন তিনি। কিন্তু নামজারি করতে গেলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবেদনগুলো নামঞ্জুর করে দেন এবং দলিল জালিয়াতির সদস্যদের স্বাক্ষর ও সিল নকল, সংগঠনের নামে ভুয়া রেজুলেশন সৃষ্টি ও রেজুলেশনের ভুয়া সত্যায়িত স্বাক্ষর সিল ব্যবহার করার জন্য তিরস্কার করেন।
বিষয়টি সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ রানাকে অবগত করা হয় এবং প্রকৃত সদস্যদের বাদ দিয়ে সংগঠনটির নিবন্ধন না করার অনুরোধ করলে টাকা দাবি করেন মাসুদ রানা।
হরিদেবপুর মধ্যপাড়া শ্রমজীবী পুরুষ ও মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রকৃত সদস্য আবু মুসা বলেন, আমরা তাদের নামে নিবন্ধন না করার জন্য আবেদন করলে তিনি আমাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। কোনো উপায় না পেয়ে আমরা তাকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিছু দিন পরে তিনি অফিসে ডেকে আমাদের কাছে আরও টাকা দাবি করেন। এরপর থেকেই একের পর এক হয়রানি করছেন মাসুদ রানা। সংগঠনের রেকর্ডপত্র যাচাইয়ের নামে একের পর এক নোটিশ জারি করতে থাকেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কথা বললে মাসুদ রানা আমাদের বলেছেন- এ বছর জুলাই মাসে উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের সম্মতি আদায় করতে যান তিনি। সেখানে সম্মতি না পেয়ে আমাদেরকে এলাকা ছাড়া করার জন্য মহব্বর হোসেনের দ্বারা আমাদের জামায়াত-শিবিরের সদস্য ও জঙ্গি সাজিয়ে সদর থানায় অভিযোগ করান। তার কারণে আমাদের অনেক দিন পুলিশের ধাওয়া ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাসুদ রানা তার দুর্নীতি চালাতে একই সমবায় সমিতিতে একাধিক পদ দখল করে রয়েছেন। রংপুরের নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলস ক্লাব পর্যটন শিল্প সমবায় সমিতির লিমিটেডের নিবন্ধনের সুপারিশকারী, একই সময়ে সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ, অডিট অফিসার হিসেবে অডিটকরণ, একই ধারাবাহিকতায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ গ্রহণ করেন। যা তার আর্থিক দুর্নীতি ও অনৈতিক প্রভাব খাটানোর বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে বলে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মাসুদ রানা বলেন, আমার বিরুদ্ধে একটি দল পেছনে লেগেছে। তারা আমাকে রংপুর থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। তাই তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
মাসুদ রানার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে রংপুর বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের যুগ্ম-নিবন্ধক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস বলেন, মাসুদ রানার বিরুদ্ধে কয়েকদিন ধরে এই অভিযোগগুলো শুনছি। আমরা খুব শিগগিরই তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করব। যদি প্রমাণিত হয় তাহলে অফিসিয়ালি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাসুদ রানার বিরুদ্ধে কয়েকবার ঢাকা সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক শরিফুল ইসলামের কাছে অভিযোগ গেলেও তিনি কোনো অভিযোগ পাননি বলে এই প্রতিবেদককে জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর