‘আমাগো আব্বু আর আইবো না, গুল্লি কইরা মাইরা ফালাইসে। আব্বুর মতো আর কেউ আমগোরে আদর করে না।’

শহীদ মো. মনিরের (৩৪) আদরের ছেলে আবির (৯) ও মেয়ে জুনহা (৫) বলছিল তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবার কথা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর গুলিস্তানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন মনির। এতে চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যায় তার দুই শিশু সন্তান আবির ও জুনহা।

জানা গেছে, ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন মনির। মিছিলটি রাজধানীর বংশাল থানা সংলগ্ন এস এ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিস অফিসের সামনে পৌঁছালে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় গুলিতে প্রাণ হারান মনির।

শহীদ মনিরের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার মধ্য শম্ভুপুর গ্রামে। ওই বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, বাবার সংসারে অভাবের তাড়নায় ১০ বছর বয়সে স্বপ্নের শহর ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মনির। দীর্ঘদিন ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করেছেন তিনি। এরপর জড়ান জুটের কাজে। ঢাকার গুলিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় নিজেই জুট কেনা-বেচা করা শুরু করেন। তাতে লাভের মুখ দেখতে শুরু করলে দূর হতে থাকে তাদের পরিবারের দুর্দিন। ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু একটা গুলি তার পরিবারকে ফের অন্ধকারের সাগরে নিমজ্জিত করে। 

২০১৪ সালের দিকে প্রতিবেশী রোজিনা আক্তারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মনিরের। তাদের ১০ বছরের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান আছে। স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে রেখে ঢাকায় জুটের ব্যবসা করতেন মনির।

মনিরের স্ত্রী রোজিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে আমার স্বামী মনিরও সবার সঙ্গে আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিল চলাকালে ছাত্র জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেখানে আমার স্বামী মনিরের শরীরে গুলি লাগে। গুলিটা তার পেট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমার স্বামী মনিরের নাম্বার থেকে আমার কাছে ফোন আসে। মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে অচেনা এক লোক আমাকে বলেন ‘তিনি (মনির) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন’। পরে আমার শ্বশুর ও আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় গিয়ে মনিরের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনেন। পরের দিন ৬ আগস্ট বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে মনিরকে দাফন করা হয়। মনিরের মৃত্যুর পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, জেলা প্রশাসন, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি নেতা মেজর হাফিজের পক্ষ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছি।

রোজিনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই এবং আমাদের দুই সন্তানের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চাই।

জানতে চাইলে মনিরের বাবা আব্দুল মন্নান বলেন, মনির আমার বড় পোলা। সে সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল। তার উপার্জনের টাকায় আমাদের সংসার চলত। কিন্তু আমার উপার্জনক্ষম পোলাডারে গুল্লি কইররা মাইররা ফালাইসে। একদিকে আমার সংসার, অন্যদিকে মনিরের দুই সন্তানের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার চিন্তা। দুইয়ে মিলে এখন আমি দিশেহারা। আমার পোলা হত্যার বিচার চাই। লগে মনিরের দুই সন্তানের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চাই।

ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভ দেবনাথ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের মধ্যে তজুমদ্দিনের মনির একজন। সরকারিভাবে তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য সব কাগজপত্র পাঠিয়েছি। সরকারি বরাদ্দ এলে আমরা তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করব।

গত ৪ নভেম্বর স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে শহীদ মনিরের স্ত্রী রোজিনা আক্তার বাদী হয়ে ঢাকার সি.এম.এম.আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন। এটির সি আর মামলা নম্বর ১৬৫৯। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে শেখ রেহানা, ওবায়দুল কাদের, শেখ ফজলে নুর তাপস, ফেরদৌস আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন উর রশিদ, ভোলা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নুরনবী চৌধুরী শাওন, ভোলা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবসহ পুলিশ, র‍্যাব, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের ২২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরও ৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ছাত্র জনতার যৌক্তিক দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছিল। কোনো প্রকার উসকানি ছাড়া পুলিশ, র‍্যাব, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী একত্রিত হয়ে ছাত্র জনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে যার মধ্যে মনির একজন। তৎকালীন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ১ নম্বর আসামি শেখ হাসিনা আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলন শক্ত হাতে দমন করার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ১ নম্বর আসামি শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশ ৪ নম্বর আসামি থেকে ২২৪ নম্বর আসামিরাসহ অজ্ঞাত আরও অন্তত ৩০০ জন নির্বিচারে ছাত্র জনতার ওপর গুলি চালায়।

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই-আগস্টে ঢাকা ও চট্রগ্রামে সহিংসতায় শহীদদের মধ্যে ৪৬ জনের বাড়ি ভোলার বিভিন্ন উপজেলায়। তাদের মধ্যে মনির একজন। ভোলায় গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান একজন।

এফআরএস