তিন বছরেও চালু হয়নি ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বর্জ্য শোধনাগার
বরগুনায় উদ্বোধনের দীর্ঘ তিন বছর পার হলেও এখনো চালু হয়নি পৌর শহরের নির্মিত একমাত্র বর্জ্য শোধনাগারটি। ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ শোধনাগারটির নির্মাণকাজের ত্রুটি ও লোকবল সংকটসহ নানা কারণে বন্ধ রয়েছে বর্জ্য শোধনের কার্যক্রম। তবে সমস্যা সমাধান করে দ্রুত কার্যক্রম চালুর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বরগুনা পৌরসভার প্রশাসক মো. তানজীম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলজিএসপি প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বরগুনা সদর ইউনিয়নের হেলিবুনিয়া নামক এলাকায় একটি আধুনিক বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা হয়। তবে তিন বছর আগে এর নির্মাণকাজ শেষ হলেও বরগুনা পৌর শহরের সব বর্জ্য ফেলা হতো পূর্বের নির্ধারিত পৌরসভার সোনাখালী নামক এলাকার একটি খোলা জায়গায়। আবাসিক এলাকা ও জনবসতিপূর্ণ স্থান হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে কিছুদিন ধরে বর্জ্য শোধনাগারেই ফেলা হচ্ছে শহরের বর্জ্য। কিন্তু দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল, নির্মাণকাজে ত্রুটি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ঘাটতি থাকায় বর্জ্য শোধনের কাজ শুরু করতে পারছে না পৌর কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পৌরসভার দায়িত্বে পৌর প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন বরগুনা জেলা প্রশাসনের তানজিম ইসলাম। পরে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বর্জ্য শোধনাগারটি চালু করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে বরগুনা পৌরসভায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত জনবলকে দক্ষ ও নির্মিত শোধনাগারের যান্ত্রিক ত্রুটি খুঁজে সমাধানে কাজ করছেন একই প্রকল্প ফরিদপুর পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত এসডিসির কর্মীরা।
আরও পড়ুন
বরগুনা ও কলাপাড়া পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে নিযুক্ত মিউনিসিপ্যাল কোর্ডিনেটর মো. বাবলু সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনা পৌরসভার নির্মিত বর্জ্য শোধনাগারে যে-সব ত্রুটি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এখানে ফেলা পচনশীল বর্জ্য ঠিকভাবে পচে না। এর কারণ সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ফাঁকা ফাঁকা ইট দিয়ে বর্জ্য রাখার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস প্রবেশ করায় কাজের কাজ হচ্ছে না। এ ছাড়া পৌরসভার কিছু পরিকল্পনারও ঘাটতি আছে পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ সমস্ত বর্জ্য দিয়ে সার উৎপাদনের যে ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেগুলোও এখানে নেই।
বর্জ্য শোধনাগারটির সমস্যা খুঁজে বের করা ও জনবলকে প্রশিক্ষিত করতে ফরিদপুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লাইন সুপার ভাইজার মো. মিজানুর রহমান বরগুনায় কাজ করতে এসে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফরিদপুরে বর্জ্য বাছাই শেষে যেখানে রাখা হয় তা প্লাস্টিকের তৈরি, আর এখনে ওই জায়গাটি তৈরি করা হয়েছে ফাঁকা ফাঁকা ইট দিয়ে। ফলে আলো-বাতাস প্রবেশ করায় বর্জ্য ঠিকভাবে পচে না। এ কারণেই এখানকার বর্জ্য দিয়ে সার তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া ফরিদপুরে মেশিনের মাধ্যমে বর্জ্য পচানোর পরে বেড থেকে বাইরে নিয়ে শুকানো হয়। পরে একটি চালনির মাধ্যমে শুকনো বর্জ্যের সাইজ অনুযায়ী আলাদা করে সার তৈরি করা হয়। ওই ধরনের চালনির ব্যবস্থাও এখানে নেই। এ ছাড়া পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহের পর রাখার জন্য বেড থাকলে এটি পরিশোধন করে পানি ছাড়তে কোনো ফিল্টারের ব্যবস্থাও নেই।
আরও পড়ুন
অপরদিকে কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা না করেই দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে পৌর শহরের সব বর্জ্য ফেলা হয় পৌরসভার সোনাখালী নামক এলাকার একটি খোলা জায়গায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের বর্জ্য ফেলা বন্ধের দীর্ঘদিনের দাবি ও ফেলে রাখা বর্জ্যের দুর্গন্ধ, রোগবালাই এবং পরিবেশের কথা চিন্তা করে আধুনিক বর্জ্য শোধনাগারটি নির্মাণ করা হয়। তবে নির্মাণের পর এখনও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না সোনাখালী এলাকায় স্তূপ আকারে ফেলে রাখা বর্জ্য। এতে নানাবিধ রোগে আক্রান্তসহ তীব্র দুর্গন্ধে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের।
সোনাখালী এলাকার বাসিন্দা মোসা. শাহিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ময়লা ফেলার কারণে এলাকায় মাছির উপদ্রুত বেশি হয়। সবসময় ঘরের খাবার ঢেকে রাখতে হয়। দুর্গন্ধ তো আছেই তারপর মাছির কারণে অনেকেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া যখন অগুন দিয়ে পোড়ানো হয়, তখন ধোঁয়ায় ঘরে থাকা যায় না, শ্বাসকষ্ট হয়।
মো. জান্নাতুল ইসলাম নামের একই এলাকার আরেক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ময়লার কারণে আমরা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এরমধ্যে আমাদের এক প্রকার বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। যখন আগুন দিয়ে ফেলে রাখা ময়লা পোড়ানো হয় তখন দিন-রাত এখানে আগুন জ্বলতে থাকে। এতে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আমরা আক্রান্ত হই। এ ছাড়া এর আশপাশ থেকে মানুষ চলাচল করতে পারে না, প্রায়সময়ই এখানে থাকা কুকুর মানুষকে আক্রমণ করে। এখানে ফেলা ময়লা লোকালয়সহ পুকুর এবং ফসলের মাঠে গিয়ে পরায় ঠিকভাবে মাছ চাষ ও কৃষি কাজ করা যায় না। এমনকি বাসায় কোনো মেহমান আসলে মশারি টানিয়ে খাবার খাওয়াতে হয়। সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার সবারই আছে। আমরা সরকারের কাছে এ ময়লার হাত থেকে বাঁচার দাবি জানাই।
পৌরসভার আধুনিক বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা হলে কিছু ত্রুটির কারণে এখনও সম্পূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে বরগুনা পৌরসভার প্রশাসক মো. তানজীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনা পৌর সম্মিলিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদের পুনঃব্যবহারের উদ্দেশ্যে একটি সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়। আশা করা হয় এর মাধ্যমে পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি সুষ্ঠুভাবে চলবে। তবে বর্তমানে প্লান্টি শতভাগ ফাংশনাল করা যায়নি। এখানে কিছু কাজ যেমন, অর্গানিক ইনঅর্গানিক ওয়েস্টগুলোকে আলাদা করা হচ্ছে। তবে এসব কাজ করতে প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন রয়েছে যা বর্তমানে বরগুনা পৌরসভায় নেই। এ ছাড়া প্লান্টটির কিছু কার্যক্রম চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, এক্ষেত্রে এত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে পৌরসভার সক্ষমতার অভাব রয়েছে।
সমস্যা সমাধান করে দ্রুত বর্জ্য শোধনাগারটি সম্পূর্ণভাবে চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষিত জনবল সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় একটি সংগঠনকে প্লান্টটি চালুর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে বলেছি, এবং তারা তা করেছে। এ ছাড়া যে-সব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ প্রয়োজন তা পূরণ করতে অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাহিদার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। কিছু কাজ এখন চলমান থাকলেও যে-সব জায়গায় ঘাটতি রয়েছে তা সমাধান করে আশা করি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পৌরসভার এ প্লান্টি সম্পূর্ণ চালু করতে পারব।
এএমকে