উন্নয়ন বৈষম্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি মিলছে না রংপুরবাসীর। ১০০ শয্যার একটা বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু সেখানে সেবা কার্যক্রম শুরু হয়নি ৫ বছরেও!

অবকাঠামো নির্মাণের পর ৫ বছর আর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর কেটে গেছে দেড় বছর। রংপুর শিশু হাসপাতাল এখনো পড়ে আছে অচলাবস্থায়। বিগত সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিতা কেটে হাসপাতালের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন ঠিকই কিন্তু সেবার দ্বার এখনো খোলা হয়নি।

দীর্ঘসময় ধরে অব্যবহৃত থাকায় হাসপাতালটির দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো জুড়ে এখন ভূতুড়ে বাড়ির পরিবেশ বিরাজ করছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে থাকায় অন্যান্য সামগ্রীও ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘদিনের দাবি আর আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১০০ শয্যার এই শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো আলোর মুখ দেখল না হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। কবে খুলবে সেবার দুয়ার, কে দেখাবে পথ এমন প্রশ্ন এখন রংপুরবাসীর মুখে মুখে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১০০ শয্যার হাসপাতাল ভবনটি যেন নির্জন এক ভূতের বাড়ি। সেখানে সর্বত্র সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে সীমিত পরিসরে শিশু বহির্বিভাগের কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে সেখানেও রোগী বা স্বজনের আনাগোনা তেমন একটা নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আবাসিক চিকিৎসক, চারজন নার্স এবং নিরাপত্তাপ্রহরীরা কর্মহীন অলস সময় কাটাচ্ছেন। হাসপাতাল চত্বরে শিশুদের জন্য নির্মিত খেলাধুলার রাইডগুলো দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলোতে জমেছে ধুলো-ময়লা।

স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার নাজুক অবস্থা চলছে। বিভাগের দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার এই প্রতিষ্ঠানটি এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। বিশেষ করে হাসপাতালটিতে জনবল সংকট থাকায় শিশু বিভাগে চাহিদামতো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিভাগীয় এই নগরীতে একটি বিশেষায়িত পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল গড়ার দাবিতে আন্দোলন করেছেন তারা। আওয়ামী লীগ সরকার ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করে দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরেও চিকিৎসাসেবা শুরু না হওয়ায় এখন তারা হতাশ।

রংপুরের স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের সাবেক সদর হাসপাতালের ১ দশমিক ৭৮ একর জমির মধ্যে শিশু হাসপাতাল নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর। ৩১ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৮০৯ টাকার সেই কাজটি করেছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মল্লিক এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স অণিক ট্রেডিং কর্পোরেশন। ভবন নির্মাণের জন্য দুই বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ের আড়াই মাস আগে কাজ শেষ করা হয়।

তিনতলা মূল হাসপাতাল ভবনের প্রতি তলার আয়তন ২০ হাজার ৮৮২ দশমিক ৯৭ বর্গফুট। এ ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে চারতলা ভিত্তির তিনতলা সুপারিনটেনডেন্ট কোয়ার্টার। সিঁড়ি বাদে প্রতি তলার আয়তন দেড় হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ডক্টরস কোয়ার্টারের নিচতলায় গাড়ি পার্কিং, দ্বিতীয় তলা থেকে ডাবল ইউনিট। আছে ছয়তলা বিশিষ্ট স্টাফ অ্যান্ড নার্স কোয়ার্টার। দুইতলা বিশিষ্ট গ্যারেজ কাম ড্রাইভার কোয়ার্টার। নিচে দুটি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। বিদ্যুৎ সাবস্টেশন স্থাপনের জন্যও নির্মাণ করা হয়েছে একটি ভবন।

শিশু হাসপাতালের মূল ভবনের প্রথম তলায় ইমার্জেন্সি, আউটডোর, চিকিৎসকদের চেম্বার এবং ল্যাব। দ্বিতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার, ব্রোন ইউনিট এবং তৃতীয় তলায় ওয়ার্ড এবং কেবিন। নবনির্মিত এই হাসপাতাল ভবনটি আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা সিভিল সার্জনকে ২০২০ সালের ৮ মার্চ হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু ওই বছর করোনা প্রাদুর্ভাব বাড়ায় ভবনটিকে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন সেখানে করোনা রোগী নেই।

হাসপাতালটি চালু হলে শিশুদের জটিল সার্জারিসহ সাধারণ সব রোগের চিকিৎসা স্বল্পমূল্যে দেওয়া যাবে এবং ভোগান্তি কমে আসবে বলে মনে করেন সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম রংপুরের সংগঠক সাব্বির মোস্তফা পিয়াল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বহু বছর ধরে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল নির্মাণের জন্য রংপুরের মানুষ আন্দোলন করেছে। বিভিন্ন সময়ে এই দাবিটি সরকারের নজরে আনতে আমরা চেষ্টা করেছি। বিগত সরকার আমাদের সেই দাবি পূরণে সদর হাসপাতালের জমিতে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করেছে। কিন্তু ভবন হস্তান্তরের পর থেকে এখনো সেখানে শিশুদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু করা তো দূরের কথা, লোকবলই নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এটি এখানকার স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে শিশু হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ সেবা কার্যক্রম শুরু করা হোক।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর জেলা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আকবর হোসেন বলেন, পুরো শিশু হাসপাতালটি এভাবে ফেলে রাখলে তা পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে সেবা কার্যক্রম চালু এখন সময়ের দাবি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া শিশুদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে এই হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক। নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে রংপুরকে পেছনে রেখে আবু সাঈদের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাই শহীদ আবু সাঈদের অঞ্চলের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা অসহায় মানুষের সন্তানদের কম খরচে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে শিশু হাসপাতালটি চালু করা এখন অতীব জরুরি।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, রমেক হাসপাতালের শিশু বিভাগ দিয়ে এ অঞ্চলের সব শিশুর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু করা উচিত। এটি চালু হলে শিশুদের জটিল সার্জারি ও সাধারণ রোগের চিকিৎসা স্বল্পমূল্যে প্রদান করা সম্ভব হবে। শিশুদের চিকিৎসা বাবদ অভিভাবকদের আর্থিক খরচ ও ভোগান্তি কমবে। পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য ঢাকা অথবা পার্শ্ববর্তী দেশে যাওয়ার প্রবণতাও অনেকাংশে কমে আসবে।

এ ব্যাপারে রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ মোস্তফা জামান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জুলাই মাসে রংপুরে যোগ দেওয়ার পর ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল চালুসহ স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে গত ১৭ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে অভিহিত করেছি। এর প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী এসবের বাস্তব চালচিত্র সম্বলিত একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করে গত ৫ নভেম্বর অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় হাসপাতালটির অবকাঠামোসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবল পাওয়া গেলেই এটি চালু করা হবে।

কবে নাগাদ চালু হতে পারে, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, দুই মাস পূর্বে রংপুরে যোগদান করে শিশু হাসপাতাল সরেজমিনে পরির্দশন করেছি। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, জনবল ও কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ এবং চাহিদা নির্ধারণ করে বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। দাপ্তরিক কাজও চলছে। মন্ত্রণালয়ের নতুন তথ্য অনুযায়ী রির্পোট তৈরি হয়েছে।

তিনি স্বীকার করেন, অব্যবহৃত থাকায় অবকাঠামোসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যত দ্রুত চালু করা যায় সেটি নিয়ে তিনি কাজ করবেন বলে জানান।

এমজেইউ