আলাদিনের চেরাগ পাওয়া এক ‘পিএস’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের সাবেক পিএস ছিলেন আমজাদ হোসেন রাজু। তিনি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন। পদে থেকে ও এমপির পিএস হওয়ায় তিনি যেন পেয়েছিলেন আলাদিনের চেরাগ। এ থেকে গত ১৫ বছরের মধ্যেই তিনি বনে গেছেন শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কুষ্টিয়া, ঢাকা, গাজীপুর, সিলেটসহ দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আলিশান ফ্ল্যাট, প্লটসহ অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। তার অর্জিত অবৈধ সম্পদের অধিকাংশই তার স্ত্রী রেবা খাতুন ও বিভিন্ন নামে-বেনামে করেছেন বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া কোটি কোটি টাকা ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করেছেন বলেও জানা গেছে। তার চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডরবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রশাসনের দৃষ্টি অকর্ষণ করেছেন কুষ্টিয়ার সুধী সমাজ। সেইসঙ্গে তার অবৈধ সম্পদের সুষ্ঠু তদন্তে দুদুকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আওয়ামী লীগ শাসনামলে তার সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি করেছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমজাদ হোসেন রাজু কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন নেতা। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং বিশ্বাসী ছিলেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি কুষ্টিয়া জেলাব্যাপী অস্ত্র ও মাদকের সব থেকে বড় কারবারি ছিলেন। এছাড়াও হানিফ এমপির পক্ষে তিনি এবং সাবেক এমপি হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা জেলার চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কুষ্টিয়া পদ্মা ও গড়াই নদীতে বছরের পর বছর ধরে অবৈধ বালু উত্তোলনের মূল হোতাদের অন্যতম ছিলেন রাজু। হানিফ এমপির নাম ভাঙ্গিয়ে সন্ত্রাসী কায়দায় খোকসা থেকে দৌলতপুর পর্যন্ত পুরো জেলায় এজেন্টের মাধ্যমে ভয়বীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করেছেন প্রায় একযুগ। হানিফ এমপির আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেনি কোনোদিন। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সস্ত্রীক আত্মগোপনে চলে যান রাজু।
আরও পড়ুন
রাজু ও তার স্ত্রীর ব্যবসা এবং সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজারের টিসিবি ভবনে আমজাদ হোসেন রাজুর মালিকানাধীন অর্নব ট্রেডিং এবং ম্যাট্রেক্স ক্যামিক্যাল নামে দুইটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। কুষ্টিয়ার মঙ্গলবাড়ীয়া বাজারে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে তার আছে নগদের এজেন্ট ব্যবসা। কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনের সামনে তার কয়েক কোটি টাকার ইলেট্রনিক্স পণ্যের শোরুম আছে যেখানে টিভি, ফ্রিজ, এসিসহ সকল ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য পাওয়া যায়।
আরও জানা গেছে, কুষ্টিয়া এবং ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় রাজু ও তার স্ত্রী রেবা খাতুনের আছে বিলাসী অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট। ঢাকার ৬৯ নম্বর গ্রিন রোডে (কমফোর্ট এর বিপরীতে) লিফটের ১১ তে ২ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, ১২৫ কলাবাগান লেক সাকের্লে (লিফট এর ৬) ৩ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, কুষ্টিয়ায় ছয় রাস্তার মোড়ে ফয়সাল টাওয়ার ২২ এ আছে আরও একটি ফ্ল্যাট।
ক্ষামতা অপব্যবহার করে অবৈধ পন্থায় আমজাদ হোসেন রাজু কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বেশ কয়েকটি দোকান। যার মধ্যে- কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ মার্কেটে একটি দোকান, বটতৈল জেলা পরিষদ মার্কেটে একটি ও দৌলতপুর জেলা পরিষদ মার্কেটে একটি দোকান আছে। এছাড়াও প্রভাব খাটিয়ে রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া আমজাদের কুষ্টিয়া শহরের প্রাণ কেন্দ্র পরিমল টাওয়ারে দুইটি দোকান এবং ভেড়ামারা কাঠের পুলে একটি দোকান আছে।
অবৈধ টাকা দিয়ে রাজু নিজের নামে, তার স্ত্রী রেবা খাতুনের নামে এবং নামে-বেনামে সম্পদ আরও সম্পদ গড়েছেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বসিলার আঠিবাজার হাউজিংয়ে কিনেছেন ৮ কাঠা জমি। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকার গাজীপুরে ১ বিঘার প্লট যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৬ থেকে ৮ কোটি টাকা, কুষ্টিয়া দৌলতপুরে আছে ১০ বিঘার ওপর বিশাল এক আম বাগান যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা এবং ভেড়ামারায় হীরিনদী তীরবর্তী গোরস্থানের পাশে ১০ কাঠার আম বাগানও আছে।
আরও পড়ুন
আমজাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরের মিসকো সুপার মার্কেটে এসএস প্রিন্টিং নামের গার্মেন্টস রয়েছে তার। যা তিনি ভেড়ামারার টাক বাবলুর সঙ্গে ৫০ শতাংশ যৌথ মালিকানায় গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও ভেড়ামারার আশরাফুল এবং জনতা ব্যাংকে চাকরিরত ব্যাংকার ভাইরা ভাই চঞ্চলের সঙ্গে তার আছে ঠিকাদারি ব্যবসা। নাসির গ্লাস কোম্পানির সঙ্গেও তার আছে বালি সাপ্লাই ব্যবসা। যৌথ অংশীদারিত্বে বারো আউলিয়ার দেশ সিলেটেও আছে একটি আধুনিক মার্কেট। যার পার্টনার হিসেবে আছেন সিলেটের স্থানীয় মাসুম নামে এক ব্যবসায়ী। ওই মার্কেটের রাজু ৩০ শতাংশের মালিক বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। কুষ্টিয়ার পদ্মা এবং গড়াই নদীতে বালু ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য তার আছে কোটি টাকা মূল্যের নৌকা। তিনি নিজের ব্যবহারের জন্য টয়োটা কোম্পানির নোহা স্কয়ার মডেলের যে গাড়ি ব্যবহার করেন সেটির দাম অন্তত ৬৫ লাখ টাকা।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে আমজাদ হোসেন রাজু পলাতক এবং তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ আছে। তাই এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও তার ব্যবসায়ী পার্টনার সিলেটের মাসুম এবং ব্যাংকার ভাইরা ভাই চঞ্চলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
রাজু আহমেদ/এফআরএস