রংপুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি মামলায় ‘ইচ্ছেমতো’ আসামি করার অভিযোগ উঠেছে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামুর বিরুদ্ধে। গত শনিবার (১৬ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মামলার বাদীর একটি ভিডিও বক্তব্য ভাইরাল হলে বিষয়টি সামনে আসে। সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকালে সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন সামু। 

এদিকে মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ নভেম্বর রংপুর মহানগরের কোতোয়ালি থানায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংঘর্ষ নিয়ে একটি মামলা করেন ২৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ।

মামলায় মামুনুর রশীদ উল্লেখ করেছেন, গত ১৯ জুলাই রংপুর সিটি বাজারে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে তিনি আহত হন। এ মামলায় ১৮১ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় অনেক নিরীহ ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

১৬ নভেম্বর মামুনুর রশীদের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে মামুনুর রশীদকে বলতে শোনা যায়, তিনি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ২৫ জন চিহ্নিত সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহানগর বিএনপির সভাপতি সামসুজ্জামান সামু ১৮১ জনের নাম দেন।

ভিডিওর ওই কথোপকথন ছিল রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও শহর কমিটির সাবেক সভাপতি কাওছার জামান বাবলার সঙ্গে মামলার বাদী মামুনুরের। ভিডিওতে মামুনুরের উদ্দেশে কাওছার জামান বাবলা বলেন, ‘১৮১ জনকে আসামি করে তুমি একটা মামলা করেছো কোতোয়ালি থানায়। এখানে নীলফামারীর আসামি আছে। এখানে অনেক নিরীহ লোক আছে। যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এটা কেন তুমি করলা?’ জবাবে মামুনুরকে বলতে শোনা যায়, ‘বিএনপির মহানগর আহ্বায়ককে (সামসুজ্জামান) আড়াই মাস আগে ২৫টি নাম দিই। ৯ কি ১০ তারিখ মামলাটা লেখা হয়েছে। আমি সই করলাম। তখন আমি অসঙ্গতি দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, এতগুলো নাম কেন? বলল, এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। এতগুলো নাম দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না।’

এ নিয়ে কাওছার জামান বাবলার কথা হলে তিনি ভিডিওর কথোপকথনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দুই দিন আগে মাহিগঞ্জের স্থানীয় কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি তার কাছে এসে মামলার আসামি হওয়ার কথা জানান। তখন তিনি মামলার বাদী মামুনুরকে ডেকে নিয়ে তার বক্তব্য শোনেন। মামুনুর তখন তাকে বলেন, ১৮১ জন আসামির বিষয়ে তিনি জানেন না। তিনি ২৫ অভিযুক্ত ব্যক্তির তালিকা সামসুজ্জামানকে দিয়েছেন। ১৮১ জন আসামির বিষয়ে সামসুজ্জামান তাঁকে বলেছিলেন, এগুলো রাজনৈতিক মামলা। এভাবেই হয়। কাওছার জামান বাবলার অভিযোগ, মামলা বাণিজ্য করার জন্য ইচ্ছেমতো আসামি দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার তিনি নিরাপত্তা চেয়ে মাহিগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বলেও জানান কাওছার জামান বাবলা।

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হলে মামলার বাদী মামুনুর রশীদ আত্মগোপন করেছেন। তার দুটি মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এ নিয়ে সোমবার সকালে রংপুর মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত দুই দিন থেকে তার ও মহানগর বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য এই ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। 

তিনি দাবি করেন, মামলার বাদীকে চিকিৎসা বাবদ তিনি সহায়তা করেছেন। তবে মামলার আসামি কে বা কারা হবেন, এটা তার বিষয় নয়। সামসুজ্জামান উল্টো কাওছার জামান বাবলা ও মহানগরের কয়েকজন বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন।

রংপুরে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্য অপপ্রচার চালিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে সামসুজ্জামান সামু বলেন, রংপুরের একটি মহল বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্টের গভীর ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপির ভেতরে ঘামটি মেরে থাকা একটি চক্র জনসম্মুখে দলের ভাবমূর্তি নস্ট করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী দোসরদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন জনকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদের নামে তা চালিয়ে দেওয়ার কূটকৌশল করছে। এই মহলটি দলীয় পদ-পদবির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা বিগত খুনি হাসিনা হঠাও আন্দোলনে কোনো মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয়নি। বরং তারা আন্দোলনকে ব্যাহত করতে নানা প্রকার প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছে। 

কাওছার জামান বাবলাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানে ফ্যাসিস্ট খুনি সরকারের পতন হলে ৫ আগস্টের পর থেকে এদের কেউ কেউ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-জমিজমা দখল করেছে। নানা অপকর্ম করছে। মানুষজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তারা মহানগর বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে। যা মিডিয়ায় কর্মরত কিছু আওয়ামী দোসরদের মাধ্যমে প্রচার করছে। যা কোনোভাবেই সঠিক নয়। আমিসহ মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। সেই সঙ্গে সকল অপকর্ম ও বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার রুখে দেওয়ার আহ্বান জানাই।

সামসুজ্জামান সামু বলেন, যাদের নামে মামলা হয়েছে ওরা কারা। কাওছার জামান বাবলা আওয়ামী লীগের লোকজনকে শেল্টার দেওয়ার জন্য কেন চেষ্টা করছে। মটর মালিক সমিতির জনৈক নেতার সঙ্গে বিএনপির কয়েকজন নেতা বৈঠক করেছে। ওই সমিতিতে যেন সাধারণ সদস্যরা নির্বাচিত হতে না পারে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া মটর শ্রমিক ইউনিয়নে বিএনপির ত্যাগী কর্মীরা যেন নির্বাচিত হতে না পারে, আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মা যেন আগামীতে থাকতে পারে সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে তারা। মহানগর বিএনপিকে শক্তিশালী করতে নেতাকর্মীরা যত কষ্ট করা দরকার করবে। যারা আমার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে দলের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে মহানগর বিএনপির সদস্য সুলতান আলম বুলবুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ মিয়া, জামিল খান, প্রভাষক শাহিনুল ইসলাম শাহিন, রেজাউল করিম লাভলু, রফিকুল ইসলাম রফিক, সামসুজ্জোহা সাজু, রফিকুল আজাদ, অ্যাডভোকেট ওসমান গণি রুবেল, হারুন অর রশিদ হারুন, জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু, সাধারণ সম্পাদক শাহ জিল্লুর রহমান জেম্স, বিভাগীয় শ্রমিক দলের সদস্য সচিব জসিম উদ্দিন, জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক, শ্রমিক নেতা হারুন চৌধুরী, ওলামা দলের মহানগর আহ্বায়ক জামাল উদ্দিন ফয়জী, মহানগর যুবদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন মিন্টু, মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাজেদুল সবুজ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও মহানগর ও  জেলা বিএনপি এবং যুবদল, ছাত্রদল, কৃষক দল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ওলামা দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল নেতার এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপির অন্য নেতারা। মামুনুর রশীদের মামলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে না থেকেও অনেক নিরীহ ও হতদরিদ্র মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এতে করে মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন।

ভুক্তভোগী মাহিগঞ্জ বালাটারী গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, আমি ও আমার ছেলে আল-আমিন দুজন মিলে ভাঙারির ব্যবসা করি। হঠাৎ করে শুনি আমার ছেলের নামে মামলা হয়েছে। অথচ সে কোনো রাজনীতি করে না। এরপর থেকে আমার ছেলে বাড়িতে থাকতে পারে না। সারাক্ষণ ভয়ে থাকে।  

মাহিগঞ্জের জমিলা বেগম বলেন, আমার স্বামী অন্ধ। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। আমার ছেলে জুয়েল কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত নেই। হঠাৎ করে শুনি আমার ছেলের নামে কেস দেওয়া হইছে। আমরা গরিব, কোনো ঝামেলার সাথে আমরা ছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ করে কেন কেস দেওয়া হইলো বুঝলাম না। আমার ছেলের বিরুদ্ধে কেস তুলে দেওয়া হোক।

রংপুর নগরীর ২৫নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নুরুন্নবী ফুলু বলেন, আমি নির্ভেজাল মানুষ হওয়ায় এলাকার মানুষ আমাকে বারবার সাবেক পৌরসভা ও বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত করেছে। আমি কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। মামুনুর রশীদকে আমি কখনো দেখিনি, তার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। সেই সাথে মামুনুর রশীদও আমাকে চেনেন না বলে আমি জানি। কিন্তু তার মামলায় আমার নাম ঢোকানো হলো। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির বিষয়ে আমি সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ মামলা থেকে আমাকে অব্যহতির দাবি জানাচ্ছি।

এ নিয়ে মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম মিজু, মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আব্দুস সালাম, বিএনপি নেতা আবু আলী মিঠু, সেলিম চৌধুরীসহ অন্যরা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমরা গায়েবি মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছি। সপ্তাহের ৫ দিনই আমাদের আদালতপাড়ায় থাকতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও যদি এমন নিয়ম চালু থাকে এবং সেটি যদি বিএনপি নেতা করে তবে তা দুঃখজনক-লজ্জাকর। আমরা মনে করি এ অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সেই সাথে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর