বিএমডিসির আইন অমান্য করে দাঁতের চিকিৎসাসেবা প্রদান করায় প্রশাসন একাধিকবার কামাল হোসেন নামে একজনকে জেল-জরিমানা করেছে। এমনকি তার প্রতিষ্ঠান ‘মা ডেন্টাল কেয়ারে’ অভিযান পরিচালনা করে সব চিকিৎসাসামগ্রী জব্দ করে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। এরপরও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চলছে তার দাঁতের চিকিৎসাসেবার নামে রমরমা বাণিজ্য। প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করায় প্রতারিত হচ্ছে চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সম্প্রতি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট বাজারে মা ডেন্টাল কেয়ার নামক প্রতিষ্ঠান খুলে আবারও তাকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে দেখা গেছে কামাল হোসেনকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির চিকিৎসা করার সুযোগ নেই। কিন্তু ডিপ্লোমা ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট কামাল হোসেন রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন—এমন প্রমাণ পেয়ে গোসাইরহাটের উপজেলা প্রশাসন তাকে একাধিকবার জেল-জরিমানা করেন। জেল থেকে বের হয়ে কামাল হোসেন আবারও একই অপরাধ সংগঠিত করায় প্রশাসন তার প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে চিকিৎসার সব সামগ্রী জব্দ করে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেয়। এরপরেও অদৃশ্য শক্তির বলে কামাল হোসেন চরাঞ্চলসহ অসচেতন মানুষের দাঁতের চিকিৎসাসেবা প্রদানের নামে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।

কামাল হোসেনের মা ডেন্টাল কেয়ারে বিডিএস চিকিৎসক ডা. মো. ফারুক হোসাইনের সপ্তাহে এক দিন রোগীদের সেবা প্রদান করার কথা থাকলেও তিনি কয়েক মাসে একবার আসেন বলে জানিয়েছেন রোগীরা। ফারুক হোসাইনের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন কামাল হোসেন। এসব রোগীদের অধিকাংশই জানেন কামাল হোসেনই ডাক্তার। রোগীপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ভিজিট নেন কামাল হোসেন। রোগী দেখা শেষে প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীদের দাঁতের যাবতীয় চিকিৎসা ও ছোট-বড় অপারেশনের নামে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেন তিনি।

চিকিৎসক না হয়েও মানুষের শরীরের অন্যতম অঙ্গ মুখ ও দাঁতের চিকিৎসা করায় রোগীরা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। উপজেলা শহরের প্রধান বাজারে চেম্বার খুলে চিকিৎসা প্রদান করেন বলে অনেকেই জানেন না কামাল হোসেন ডিগ্রিধারী চিকিৎসক নন। একাধিকবার জেল-জরিমানা ও চিকিৎসা সামগ্রী জব্দের পরেও কী করে কামাল হোসেন রোগীদের সেবা করেন—এমন প্রশ্ন এখন সবার।

সাহিদা বেগম (৫৫) অতিরিক্ত পান খাওয়ার ফলে দাঁতের বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন গোসাইরহাটের মা ডেন্টাল কেয়ারে। কামাল হোসেন সাহিদা বেগমের দাঁতের চিকিৎসা করার পরে সাহিদা বেগমের দাঁত ব্যথা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে তার স্বজনরা চিন্তিত হয়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকার চিকিৎসক সাহিদা বেগমকে জানান সুস্থ দাঁত কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছে। ভালোমানের চিকিৎসা না হওয়ায় ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছেন তিনি।

সাহিদা বেগম বলেন, কামাল ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়ার পর আমার মুখে দিন দিন ব্যথা বাড়তে থাকায় ছেলেরা আমাকে ঢাকা নিয়ে যায়। পরে ঢাকার ডাক্তার জানিয়েছেন, ভালো চিকিৎসা না করে আমার সুস্থ দাঁত কেটে দিয়েছেন কামাল ডাক্তার। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে আমার নাকি ক্যান্সার হতো। কামাল ডাক্তারের কাছে হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা নেয়। সে যদি ডাক্তার না হয় তাহলে বাজারের মধ্যে দোকান খুলে রোগী দেখেন কেমনে?

কুচাইপট্টি এলাকা থেকে কামাল হোসেনের কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন মায়া বানু নামে এক বৃদ্ধা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কামাল ডাক্তারের নাম আমাকে পাশের বাড়ির এক ভাবি বলেছে। ভাবির দেওয়া তথ্য মতে কামাল ডাক্তারকে দেখাতে এসেছি। এর আগেও একদিন এসেছিলাম। ওই দিন তিনি আমাকে বলেছিলেন দাঁত বাঁধাইতে হবে। তিনি আমার দাঁত বাঁধাই করে দেবেন। আমরা গরীব মানুষ, শহরে ডাক্তার দেখাতে অনেক টাকা লাগে। কামাল ডাক্তার কম টাকায় চিকিৎসা করেন।

চিকিৎসাসেবা প্রদানের বিষয়ে কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিক চিকিৎসাসমূহ করি আমি। আমার স্যার (ডা. ফারুক হোসাইন) অপারেশনসহ অন্যান্য চিকিৎসা করেন। আমি ড্রেসিং করি।

রোগী দেখা প্রেসক্রিপশন প্রদান, অপারেশনসহ অন্যান্য সব সেবাই আপনি করেন রোগীরা এমনটি জানিয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রোগীরা না জেনে বলেছেন। এর আগে একাধিকবার আপনার প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেল জরিমানা ও মালামাল জব্দ করেছে, কী অপরাধ পেয়েছিল আপনার? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কামাল হোসেন চেম্বার ছেড়ে চলে যান।

গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মা ডেন্টাল কেয়ারে এর আগে ইউএনও ও এসিল্যান্ড অভিযান পরিচালনা করেছিল। অভিযানে আমিও ছিলাম। ভ্রাম্যমাণ আদালত তার চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সামগ্রী জব্দ করে নিয়ে এসেছিল। এরপর একটি চিঠির মাধ্যমে কামাল হোসেন সামগ্রীসমূহ নিয়ে যান। শুনেছি কামাল হোসেন আবারও চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত যদি অভিযান পরিচালনা করে, সেখানে আমিও থাকব।

শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডা. আবুল হাদি মোহাম্মদ শাহ পরাণ বলেন, ডাক্তার না হয়ে কেউ চিকিৎসা সেবা প্রদান করার সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সাইফ রুদাদ/এএমকে