১২ লাখ টাকার ঋণের চাপে জর্জরিত হয়ে প্রায় ৯ বছর আগে মা-বাবা, বড় ভাই ও ছোট বোনকে নিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় পাড়ি জমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার দক্ষিণ ইসলামপুর গ্রামের মো. তারিক হোসেন (১৮)। তার বাবার নাম আশাদুল ইসলাম (৪২)। তার বাবা ও বড় ভাই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতেন আর তারিক কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন।

গত ৫ আগস্টের আগে প্রায় ১১ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে থাকে তারিকের পরিবার। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার শেরেবাংলা থানার সামনে তারিক হোসেনের পেটে চারটি ও হাতে একটি গুলি লাগে। চার দিন আইসিইউতে ভর্তি থেকে মারা যান তিনি। পরে ১০ আগস্ট তারিকের মরদেহ নিয়ে এসে গ্রামের বাড়ির গোরস্থানে দাফন করে তার পরিবার।

নিহত তারিক হোসেনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মহানন্দা নদীর ধার ঘিরে ঘাস জমিতে বসবাস করছেন তারা। ছেলের কথা বলতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলছেন তারিকের মা আর ছেলে হারিয়ে তারিকের বাবা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

তারিক হোসেনের বাবা মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, দেনায় (ঋণ) জর্জরিত হওয়ার কারণে আমরা পরিবারসহ ঢাকায় গিয়ে থাকি। বড় ছেলে এবং আমি রিকশা চালাতাম আর ছোট ছেলে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতো। আমার ছোট ছেলের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে ছোট বোনসহ আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাবতো। আমার এই ছেলে সব দিক থেকেই ফিট ছিল। সে আমাকেসহ মিছিলে যেতে চাইতো। বলতো, কত মানুষ মারা যাচ্ছে, দেশের অবস্থা ভালো না। একে (শেখ হাসিনা) হটাতেই হবে। সেই থেকে আমার ছেলে মিছিলে গিয়েছিল এবং মিছিলে গিয়ে নিহত হয়েছে। আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তাদের সবার বিচার চাই। তাদেরকে আমি কখনোই মাফ করব না।

কান্নাজনিত কণ্ঠে নিহত তারিক হোসেনের মা ফেরদৌসী বেগম বলেন, আমার ছেলের খুব স্বপ্ন ছিল। সে বলত মা আমাদের কষ্ট হইলেও তোমাকে কোথাও কাজ করতে যেতে দেব না। আমার বোনকে সব কিছু (গহনা ও অলংকার) বানিয়ে দেবে। তাকে কখনো কষ্ট দেব না। আমি একটা কাঠের দোকান দেব আর আমার ভাইকে সেখানে মালিক করে রাখব। আমার ছেলে কোনো দিন আমাকে কষ্ট দেয়নি। আমার ছেলে ছোট হলেও সব কাজ শিখেছিল। আর বলতো মা এখন আমি কাজ শিখে নিয়েছি। এতদিন তোমাকে আমি খাওয়াতে পারিনি, এখন তোমরাকে খাওয়াব। সেদিন (৫ আগস্ট) সকালে উঠে আমাকে বলেছিল আজকে আমি মিছিলে যাবে মা, আমার আব্বাকে নিয়ে আমি মিছিলে যাব। আমি বলেছিলাম, আব্বা তুমি যেও না মিছিলে, কিন্তু আমার ছেলে বলেছিল মা দেশের জন্য তো সব কিছু করা লাগে। সারাজীবন কী পেট পেট করে মরব? মিছিল থেকে এসে আবার সন্ধ্যার দিকে শেরেবাংলা থানার সামনে মিছিলে গিয়েছিল। তারপর মিছিলে গিয়ে আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়।

পরে আমি জানার পর মেডিকেলে গিয়ে দেখি আমার ছেলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আর মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে। তারপর আমার ছেলেকে অপারেশনের ঘরে নিয়ে যায় আর আমি সারারাত বাইরে বসে থাকি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে অপারেশন রুমের দরজা খুললে আমার ছেলে আমার দিকে তাকায় এবং আমার কাছে পানি খেতে চাই। কিন্তু নার্স আমার ছেলেকে পানি দিতে দেয়নি। নার্স বলেছিল আমার ছেলে পানি খেতে পাবে না। কিন্তু আমার ছেলে বারবার পানি খেতে চেয়েছিল। বারবার আমার ছেলে শুধু আমাকে বলছিল আমাকে কিছু খেতে দাও মা। চার দিন আমার কাছে খেতে চেয়েছে আমার ধন, কিন্তু আমি কিছু খেতে দিতে পারিনি। আমার ছেলের মুখের তালুর সঙ্গে শুকিয়ে জিহ্বা লেগে গিয়েছিল। আর আমার ছেলে বলছিল, আমি আর অক্সিজেন সহ্য করতে পারি না মা, আমাকে একটু পানি খেতে দাও মা।

তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর আগে আমার ছেলে তিনবার মা মা বলে ডেকেছিল কিন্তু আমার ছেলের শেষ ডাক শুনতে পাইনি। আমার ছেলের খুনির সুষ্ঠু বিচার চাই।

নিহত তারিক হোসেনের বোন আশরিফা খাতুন বলেন, আমার ভাই অনেক ভালো ছিল। আমার জন্য অনেক ভাবতো। আমার ভাইয়ের হত্যার যেন সুষ্ঠু বিচার হই। আমার ভাই রক্ত দিয়ে নতুনভাবে দেশ স্বাধীন করেছে। তাই ভাইয়ের খুনিদের বিচার চাই।

নিহত তারিক হোসেনের দাদা তাতিন মিয়া বলেন, আমার পোটা (নাতি) খুবই ভালো ছিল। আমাকে বলতো মানুষের বাড়িতে আর আপনাকে কাজ করতে দেব না। আপনারা অনেক কষ্ট করেছেন এখন আমি কাজ শিখে নিয়েছি। মাসে ২২ হাজার টাকা বেতন পাই। তাই আপনাকে আর কাজ করতে দেব না। এ ছাড়া আমাকে বলেছিল আমি বাড়িতে এসে ইট কিনে বাড়ি বানাব। আমার নাতির খুব স্বপ্ন ছিল। অন্যদিকে আমার নাতি মারা যাওয়ায় আমার ছেলে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। ছেলের শোকে তিন মাস থেকে কোনো কাজকাম করতে পারে না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আব্দুর রাহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সহযোদ্ধাদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুইজন নিহত ও নয়জন আহত হয়েছে। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি এবং তাদের তালিকা করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। তাদেরকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি এবং তাদের সব সময় খোঁজ রাখার চেষ্টা করছি।

এ বিষয়ে গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত আনজুম অনন্যা বলেন, আমি শুরুতেই ৫ আগস্টে নিহত সকল শহীদ ছাত্র-জনতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডোলাতে তারিক হোসেন নামে এক আন্দোলনকারী ঢাকায় নিহত হয়েছেন। তাদের বসতভিটার জন্য চার শতক জায়গা ও একটি খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। সেটা ডিসি স্যার অনুমোদন করলে এই পরিবারের একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই আমরা করতে পারব। এ ছাড়া তারিক হোসেনের স্মরণে চৌডোলাতে একটি তারিক চত্বর করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তার বোনকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি। ইনকাম জেনেরেটিং অ্যাক্টিভিটির আওতায় তার মাকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও একটি সেলাই মেশিন বিতরণের ব্যবস্থা করছি। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন তহবিল থেকে তার কবর বাঁধানো ও নামফলকের কাজ হাতে নিয়েছি। এটা আমরা দ্রুত করে ফেলব। আশা করি সামনে ডিসেম্বরের মধ্যে জমি হস্তান্তর ও যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারব।

এমজেইউ