দ্বীপজেলা ভোলার ৭ উপজেলার সাড়ে ১৯ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে জেলার ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু প্রায় গত ২ বছরেও হাসপাতালটির শূন্য পদে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ না হওয়ায় যথাযথ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ জেলার মানুষ।

ফলে হাসপাতালে এসে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। সরকারি হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই ছুটছেন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ৬০ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৭ জন। এর মধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আছেন দুইজন। বাকি ৪৩টি চিকিৎসকের পদই শূন্য।

চিকিৎসকদের ৬০ পদের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট ১০টির সাতটি শূন্য, জুনিয়র কনসালটেন্ট ১৩টির মধ্যে ১০টি, আরএমও চারটি মধ্যে তিনটি এবং অ্যানেসথেটিস্ট চারটি পদের মধ্যে চারটিই শূন্য।

এছাড়া একটি রেডিওলজিস্ট পদের মধ্যে একটিই শূন্য, চারটি মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে একটি, ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার তিনটির মধ্যে দুইটি, সহকারী সার্জন ছয়টি পদের মধ্যে পাঁচটি, রেজিস্ট্রার ১০টি পদের মধ্যে নয়টি এবং আয়ুর্বেদিক একটি পদের মধ্যে একটি পদই শূন্য রয়েছে।

এদিকে ৯০ জন নার্সের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫৪ জন। বাকি পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য অবস্থায় আছে।

নার্সের ৩৬টি শূন্য পদের মধ্যে সেবা তত্ত্বাবধায়ক একটি, উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক একটি, চারটি নার্সিং সুপারভাইজার পদের চারটি পদই শূন্য, সিনিয়র স্টাফ নার্সের ২০টি এবং মিডওয়াইফ ছয়টি পদের সবগুলোই শূন্য।

২০১৩ সালে ৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যার ভোলা সদর জেনারেল হাসপাতালে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ সাত তলা বিশিষ্ট ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। কিন্তু ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারিতে এসে ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাহিদ মালেক।

কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকেই নানান জটিলতায় ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি চলছে ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে। আর এতেই ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ জেলার বাসিন্দারা।

সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ধারণক্ষমতার প্রায় আড়াই গুন রোগী ভর্তি আছেন ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে। রোগীদের চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। এছাড়া দুপুর ২টার পরে শুধু জরুরি বিভাগে মাত্র একজন চিকিৎসক ব্যতীত অন্য কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। রোগীদের চাপে ওয়ার্ডে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন না নার্সরা।

অন্যদিকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য স্বল্প মূল্যে সরকারিভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও জনবল সংকটের কারণে দুপুর ১টার পর থেকে হাসপাতালে আর কোনো পরীক্ষা করানো যায় না। তাই বাধ্য হয়েই দুই থেকে তিনগুণ বেশি টাকা খরচ করে বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয় রোগীদের। এতে বিড়ম্বনায় পড়েন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভোলা সদর হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার আশায় আসা দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা বৃদ্ধ ওমর ফারুক ও মো. জাহাঙ্গীর জানান, গতকাল দুপুরে ও বিকেলের দিকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আজ দুপুরে ওয়ার্ডে ডাক্তার আসছে। যদি ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার পেতাম তাহলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হতো।

ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. ইব্রাহীম জানান, আমাদের শেষ ভরসা ভোলা সদর হাসপাতাল। ডাক্তার ঠিকমতো আসে না। এতে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। এছাড়া সবগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা যদি হাসপাতালেই করাতে পারতাম তাহলে আমাদের জন্য অনেক উপকার হতো। ডাক্তার ওয়ার্ডে এসে শুধু টেস্ট লিখে দিচ্ছেন। এখন প্রাইভেট ক্লিনিকে টেস্ট করতে হবে।

হাসপাতালে ভর্তি শিবপুর ইউনিয়নের মো. জিসানের মা ইয়াছমিন আক্তার জানান, আমার ছেলেরে হাসপাতালে ভর্তি করাইছি। ডাক্তার টেস্ট লিখে দিছে। হাসপাতালে টেস্ট করাইতে পারি নাই, বাইরের থেকে ৩ গুন বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করাইয়ে নিয়ে আসছি।

রোগীর স্বজন মো. ইয়াছিন ও মো. জিসান জানান, এক দিন আগে আমার আব্বারে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করাই। তাৎক্ষণিক ইমার্জেন্সিতে একজন ডাক্তার পাই। তাও অত্যধিক ভিড় ছিল। শেষমেষ নিরুপায় হয়ে অনেকক্ষণ পর ডাক্তার দেখাতে পেরেছি।

জানতে চাইলে ভোলার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স সালমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান। তিনি জানান, নার্স সংকট। যদি কোনোভাবে নার্স সংকট কাটানো যেত, তাহলে রোগীদের সেবাটা আরও ভালোভাবে দিতে পারতাম। আমরা আসলে অনেক দুর্বিষহ। এখানে রোগীর চাপ অনেক।

সালমা আক্তার আরও জানান, আমরা বার বার কর্তৃপক্ষের কাছে সংকট কাটানোর জন্য আবেদন দিয়েছি। কিন্তু কোনোভাবেই সংকট নিরসনে ব্যবস্থা দেখছি না। আমরা এখন যেভাবে সেবা দিচ্ছি পর্যাপ্ত নার্স থাকলে সেটি আরও ভালোভাবে দিতে পারতাম।

হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স সংকট নিরসনের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ আবু আহাম্মদ শাফী ঢাকা পোস্টকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্স সংকট। সম্প্রতি এ সংকট জটিল আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নতুন কোনো চিকিৎসক প্রতিস্থাপন করেনি। অন্যদিকে হাসপাতালে নার্সেরও অনেক সংকট।

তিনি আরও জানান, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বিষয়টি বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নজর দেবে এবং ভোলা সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করবে।

এদিকে ভোলার সচেতন মহল অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে অতি দ্রুত ভোলার ২৫০ শয্যা এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের শূন্য পদ পূরণ করে ভোলাবাসীর চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন।

এফআরএস